বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া রাজিব। ইউনিভার্সিটিতে বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না। মাঝেমধ্যে মাদকও সেবন করেন। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করেন। প্রায়ই বন্ধুদের সঙ্গে বচসা-মারামারি হয়। থানা-পুলিশ পর্যন্ত বিষয়গুলো গড়ায়। একসময় একটি অবৈধ অস্ত্রসহ পুলিশ তাঁকে আটক করে। রাজিবের বাবা থানায় ছুটে যান। ছেলের পক্ষ নিয়ে তাঁর বন্ধুদের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করেন। ছেলের কোনো দোষ দেখতে পান না। বন্ধুদেরই দায়ী করে ছেলের অপরাধের সাফাই গাইতে থাকেন।
সন্তানের অপরাধে মা-বাবারা কী করবেন
সবার আগে ঠিক হতে হবে নিজেদের
কেবল সন্তানই একজন সুনাগরিক হবে আর মা-বাবারা হবেন না, তা চলবে না। সুসন্তান গঠনের আগে প্রয়োজন সৎ, নৈতিকতাবোধসম্পন্ন মা-বাবা। মনে রাখতে হবে, নৈতিকতাবোধ পাঠ্যবইয়ের পাতা থেকে অর্জন করা যায় না। পারিবারিকভাবে নৈতিকতার চর্চা না থাকলে, মূল্যবোধগুলোকে ধারণ করতে না পারলে সন্তানকে নীতিবোধ শেখানো প্রায় অসম্ভব।
চর্চাটা ছোটবেলা থেকেই
যেকোনো ছোটখাটো ভুলত্রুটিকে ছোটবেলা থেকেই শনাক্ত করতে হবে এবং তা সংশোধনের জন্য সচেষ্ট হতে হবে। ‘ও ছোট, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে’ বলে কোনো প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। ছোট ছোট ত্রুটির প্রশ্রয়ই একসময় বড় অপরাধের জন্ম দেয়।
সমন্বিত সিদ্ধান্ত
সন্তানের অন্যায় আচরণের বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের সমন্বিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দেখা যায় বাবা সংশোধনের উদ্যোগ নিচ্ছেন কিন্তু মা সন্তানকে আগলে রাখছেন। আবার মা-বাবা একমত হয়ে সংশোধনের চেষ্টা করছেন কিন্তু দাদা-নানা বা দাদি-নানিরা নানাভাবে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন। মা-বাবা একে অন্যের কাছে সন্তানের অপরাধকে কখনোই আড়াল করবেন না। সমন্বিত সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে সন্তান উল্টো সুযোগ নেবে।
অস্বীকার বা আস্ফালন নয়
সন্তানের ভুল আর অন্যায়কে স্বীকার করে তাকে সংশোধনের জন্য সমাজের সাহায্য নিন। সন্তানের অপরাধের কারণে যে বা যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের অবস্থানে নিজেকে বসিয়ে বিষয়টি ভাবুন। সন্তান অপরাধ করলে আপনি নত থাকুন, ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ বা আস্ফালন করবেন না। আপনার আস্ফালন সন্তানের পরবর্তী অপরাধকে আরও উৎসাহিত করবে।
অপরাধ ও অনৈতিকতাকে উৎসাহ নয়
কোনো ধরনের সামাজিক অপরাধ বা অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। অনেক সময় দেখা যায় বিভিন্ন বড় পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস-সংক্রান্ত বিষয়ে মা-বাবারাই উৎসাহিত হচ্ছেন। সন্তানকেও উৎসাহিত করছেন।
অন্যকে দোষারোপ নয়
অনেক সময় সন্তানের কৃতকর্মের জন্য মা-বাবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বন্ধু আর পরিবেশকে দায়ী করেন। তাঁরা ভুলে যান একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া, একই বন্ধুদের সঙ্গে মেশা, একই পরিবেশে বড় হওয়া সবাই অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েনি। কেউ কেউ স্বীয় নৈতিকতা আর মূল্যবোধকে সযত্নে রক্ষা করতে পারে, কেউ কেউ দুর্বল ব্যক্তিত্বের কারণে পারে না।
সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে উৎসাহ
ছোট ছোট সমস্যা সমাধানের কৌশল রপ্ত করা, প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারা, মানুষের সঙ্গে মিশতে পারা, অন্যকে সম্মান করতে পারা ইত্যাদি সামাজিক দক্ষতা বাড়ানোর জন্য সন্তানকে উৎসাহিত করতে হবে। সামাজিক দক্ষতা থাকলে সন্তানের মধ্যে অন্যায় আর অপরাধের প্রবণতা কমে যায়।
জানতে হবে সন্তানের গতিবিধি
সঙ্গদোষ সন্তানের বিপথগামিতার একমাত্র কারণ না হলেও অন্যতম প্রভাবশালী কারণ। তাই মা-বাবাকে জানতে হবে সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, কী করছে।
বেহিসাবি টাকা নয়
প্রাচুর্য আছে বলেই সন্তানের হাতে বেহিসাবি টাকা দেওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে, অপরিণত বয়সে বেহিসাবি অর্থ সন্তানকে বিপথগামী করে।
নিজেদের শরীর আর মনের যত্ন নিন
সন্তানের কৃতকর্মের জন্য মা-বাবা অনেক সময় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সন্তানকে সংশোধন করতে হলে, তাকে অপরাধের পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে হলে মা-বাবাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে।
অন্যের সমালোচনা নয়
সন্তানের সামনে অন্যের সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকুন। সব সময় অপরাপর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা সন্তানকে একমুখী ভাবনা ভাবতে শেখায়—সে নিজের কোনো দোষ খুঁজে পায় না, কেবল অন্যের দোষ দেখতে পায়।
সন্তানের মানসিক অবস্থা যাচাই করুন
অনেক সময় কনডাক্ট ডিসঅর্ডার, পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার, মাদকাসক্তি ইত্যাদি মানসিক সমস্যার কারণে মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা জন্ম নেয়। সে অনৈতিক আচরণ করতে থাকে। সন্তানের মধ্যে এ ধরনের কোনো সমস্যা আছে কি না, তা যাচাই করে নেওয়া দরকার। চিকিৎসায় এই ধরনের মানসিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
অপরাধের জন্য তাকে পরিত্যাগ নয়
সন্তান অপরাধ করলেও মনে রাখতে হবে সে আপনারই সন্তান। তার অপরাধকে স্বীকার করে নিন। অপরাধের জন্য তার প্রাপ্য শাস্তি মেনে নিন। প্রয়োজনে অবশ্যই তাকে আইনি সাহায্য দেবেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কোনো অনৈতিকতার আশ্রয় নেবেন না। সন্তানকে ভালোবাসবেন, স্নেহ করবেন কিন্তু তার অন্যায় আর অপরাধকে সমর্থন কখনোই নয়।
সন্তানের অন্যায়-অপরাধে প্রশ্রয় নয়
সন্তানের প্রতি মা-বাবার স্নেহ-ভালোবাসা স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্নেহ আর ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গেলে সন্তানের কোনো ভুল মা-বাবা দেখতে পান না। আবার কখনো সন্তানের ভুল বা অপরাধ বুঝতে পারেন ঠিকই, কিন্তু সামাজিক মর্যাদা আর জেদের কারণে অনৈতিকভাবে সন্তানের পক্ষÿনেন। এর পেছনে দুটি বিষয় কাজ করে—প্রথমত, মা-বাবারা তাঁদের সন্তানকে স্বার্থপরের মতো বেশি ভালোবাসেন। এই ভালোবাসার কারণে তাঁরা সন্তানের কোনো অন্যায়কে অন্যায় বলে মনে করেন না। আর সন্তানের অপরাধের কারণে বিপদ থেকে তাকে রক্ষা করতে নিয়ত সন্তানের পক্ষে সাফাই গেয়ে যান। দ্বিতীয়ত, নিজের ইগো বা অহংবোধ রক্ষা করতে তাঁদের মনোজগতে একধরনের ‘ডিফেন্স ম্যাকানিজম’ তৈরি হয়, যেটাকে বলা হয় ডিনায়াল বা অস্বীকৃতি। ফলে তাঁদের মনের একাংশ সন্তানের অপরাধ আর ভুলকে স্বীকার করে নিলেও আরেক অংশ সামাজিকভাবে জয়ী হতে সন্তানের অপকর্মকে অস্বীকার করতে থাকে।
সন্তানের ছোট ছোট ভুলগুলো ধরিয়ে না দিলে, সব সময় সন্তানের পক্ষÿনিলে তা সন্তানের নৈতিক আর চারিত্রিক বিকাশের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে একসময়ের আপাতনিরীহ ভুলগুলোর সমর্থন পেতে পেতে মা-বাবার অজান্তেই তারা জড়িয়ে পড়ে ভয়ংকর অপরাধে। আইনি সমস্যায় পড়ে বিপর্যস্ত হয়ে যেতে পারে পুরো পরিবার। ছোটবেলা থেকে সন্তানের অনৈতিক আচরণ, ছোটখাটো অপরাধকে কখনোই প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। আজ যেটিকে মা-বাবা শিশুসুলভ ‘ভুল’ হিসেবে মনে করছেন, সংশোধনের বদলে নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে সেই ভুলকে সমর্থন করছেন, সময়ের পরিক্রমায় সেই ভুলগুলোই ‘বড় অপরাধে’ পরিণত হয়ে সন্তানকে ফ্র্যাঙ্কেস্টাইনের মতো দানবে রূপান্তরিত করতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ এ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘অধর্মের মধুমাখা বিষফল তুলি/ আনন্দে নাচিছে পুত্র; স্নেহমোহে ভুলি/ সে ফল দিয়ো না তারে ভোগ করিবারে—/ কেড়ে লও, ফেলে দাও, কাঁদাও তাহারে।’
সন্তানের যেকোনো অন্যায় আচরণকে চিহ্নিত করে তা সংশোধনের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। তাই বলে আবার কঠিন নিয়মের বেড়াজালে সন্তানকে আটকে যান্ত্রিক মানব বানানো যাবে না।
কোমল আর কঠিনের মিশ্রণেই তাকে সংশোধন করতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন