জ্বরের মৌসুম।
আশপাশে পরিচিত কারও না কারও জ্বর লেগেই আছে।
কারও সাধারণ ফ্লু, কারও ডেঙ্গু, কারও আবার চিকুনগুনিয়া।
জ্বর শরীরের যেকোনো সংক্রমণ বা প্রদাহের বিপরীতে প্রথম প্রতিরোধব্যবস্থা।
তবে অতিরিক্ত জ্বর শরীরকে দুর্বল করে ফেলে।
জ্বরের কারণ অনেক। তবে
সাধারণ ভাইরাস জ্বরই বেশি হয়ে থাকে।
বিশেষ করে ঋতু বা আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে।
আবার কিছু কিছু কারণ আছে, যার কারণে যেকোনো সময় জ্বর হতে পারে।
যেমন কিছু জটিল রোগে র্যাশসহ জ্বর হতে পারে।
বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার, মস্তিষ্কের প্রদাহ, টাইফয়েড, রক্তনালির প্রদাহ, একজিমা, সেলুলাইটিস, এসএলই, আইটিপি ইত্যাদি।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, এই সময়ে ভাইরাস জীবাণুর সংক্রমণ বেশি হয়, বিশেষ করে ডেঙ্গু বা ইদানীং চিকুনগুনিয়া বেশি হচ্ছে।
ভাইরাস জ্বর সাধারণত ৭-১৪ দিন স্থায়ী হতে পারে। ওষুধ ও পুষ্টিকর খাবার খেলে এই সময়ের মধ্যে জ্বর ভালো হয়ে যায়।
সাধারণ ভাইরাল জ্বরে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
জ্বরের সঙ্গে শরীর ব্যথা, অরুচি, হালকা সর্দি-কাশি ইত্যদি এসব জ্বরের প্রধান উপসর্গ।
কিন্তু জ্বরের সঙ্গে যদি শরীরে র্যাশ বা ত্বকে ছোট লাল দানা দেখা দেয়, তবে তা ভীতির কারণ হতে পারে।
জ্বরের ধরন-ইতিহাস, অন্যান্য উপসর্গ-লক্ষণ বিশ্লেষণ, বিশেষ করে র্যাশের প্রকৃতি সঠিকভাবে চিহ্নিত করে রোগ শনাক্ত করা সম্ভব।
র্যাশ বিভিন্ন ধরনের এবং বিভিন্ন রঙের হতে পারে।
রোগ অনুযায়ী জ্বরের সঙ্গে র্যাশ দেখা দেওয়ার সময় এবং স্থানে ভিন্নতা থাকতে পারে।
ডেঙ্গু, নাকি চিকুনগুনিয়া
বর্ষা মৌসুমে আমাদের দেশে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ইত্যাদি ভাইরাসজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব হয়।
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া দুটোই ভাইরাস জ্বর।
এদের জীবাণুবাহী মশাও একই প্রজাতির, এডিস।
রোগের লক্ষণ ও উপসর্গেও নানা মিল আছে। ইদানীং জ্বর, গায়ে ব্যথা, র্যাশ বা ফুসকুড়ি দেখা দিলে অনেকেরই মধ্যে আতঙ্ক কাজ করে এটা ডেঙ্গু, নাকি চিকুনগুনিয়া? পাশাপাশি থাকে তীব্র শরীর ব্যথা। তবে পার্থক্য হলো, ডেঙ্গুজ্বরে চোখ ও মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা হয়, মাংসপেশি ও হাড়ে ব্যথাও হয়।
তবে গিরা তেমন ফুলে না বা ব্যথাও কম থাকে।
কিন্তু চিকুনগুনিয়ার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে গিরায় ব্যথা। কেউ কেউ খুঁড়িয়ে হাঁটতে বাধ্য হন।
সাধারণ চিকুনগুনিয়ায় জ্বর, ত্বকে র্যাশ, সন্ধি বা হাড়ের জোড়ায় ব্যথা ও গায়ে ব্যথা করে।
এর চেয়ে তীব্র হলে সন্ধি ফুলে যায়, গায়ে তীব্র ব্যথা, চোখে ব্যথা, রক্তচাপ ও প্রস্রাব হ্রাস প্রভৃতি সমস্যা হতে পারে।
রোগটি সবচেয়ে জটিল রূপ নিলে উচ্চমাত্রার জ্বর, সন্ধি ব্যথা ও ফোলা, বমি এবং ডায়রিয়ায় রোগী অচেতনও হয়ে যেতে পারে। তবে চিকুনগুনিয়ায় ডেঙ্গুর চেয়ে মৃত্যুঝুঁকি কিছুটা কম।
ডেঙ্গু সাধারণত ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে সেরে যায়। তবে চিকুনগুনিয়ার রোগী ৭ থেকে ১০ দিনে সেরে উঠলেও ব্যথা কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
এমনকি জ্বরটা সেরে গিয়ে আবারও হতে পারে।
টাইফয়েড জ্বর
দূষিত পানি ও খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে একধরনের ব্যাকটেরিয়া মানুষের শরীরে প্রবেশ করে টাইফয়েড রোগটি ঘটায়।
একমাত্র খাওয়ার পানি ও খাদ্যদ্রব্য ছাড়া এই জীবাণু অন্য কোনো মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করার সুযোগ পায় না।
রোগ-জীবাণু দেহে প্রবেশের সাধারণত ১০ থেকে ১৪ দিন পর রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। জ্বরই হলো এ রোগের প্রধান লক্ষণ।
প্রথম চার-পাঁচ দিন জ্বর বৃদ্ধি পেতে থাকে। জ্বর কখনো বাড়ে, কখনো কমে; তবে কোনো সময় সম্পূর্ণ ছেড়ে যায় না। জ্বরের সঙ্গে মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা ও শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেয়।
কারও কারও কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে ডায়রিয়া ও বমি হয়।
দ্বিতীয় সপ্তাহে রোগীর পেটে ও পিঠে গোলাপি রঙের দানা দেখা দিতে পারে। কারও কারও জ্বরের সঙ্গে কাশি হয়।
বাতজ্বর
সাধারণত গলায় ব্যথা হলে তা যদি যথাযথ ও সম্পূর্ণরূপে চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে এর সংক্রমণের ২ থেকে ৪ সপ্তাহের মধ্যে থেকে বাতজ্বর দেখা দিতে পারে।
বাতজ্বরের উপসর্গগুলোর মধ্যে কিছু মুখ্য আর কিছু গৌণ উপসর্গ আছে।
এসব উপসর্গ যাচাই-বাছাই করে রোগ নির্ণয় করা হয়।
সাধারণত মনে করা হয় গিরায় গিরায় কিংবা হাড়ে হাড়ে ব্যথা হলে সেটা বাতজ্বরের লক্ষণ।
তবে সবক্ষেত্রেই তা সঠিক নয়। বাতজ্বরের কিছু মুখ্য ও কিছু গৌণ লক্ষণ রয়েছে।
দুটি কিংবা একটি মুখ্য লক্ষণের সঙ্গে দুটি গৌণ লক্ষণ নিশ্চিতভাবে মিলে গেলে বাতজ্বর নির্ণয় করা যায়।
তার সঙ্গে বিটা হিমোলাইটিক স্ট্রেপটোকক্কাসজনিত সংক্রমণের ইতিহাস বা প্রমাণও থাকতে হবে।
হাম ও রুবেলায় জ্বর
শিশু ছাড়াও যেকোনো বয়সে হাম হয়।
কাশি, চোখের লালচে ভাব, সর্দি ইত্যাদি উপসর্গের পাশাপাশি জ্বর শুরুর তিন-চার দিন পর লালচে ছোপ বা লালচে ছোপ-দানাদার মিশ্র র্যাশ দেখা দেয়, যা মাথা ও গলা থেকে শুরু হয়ে শরীর-হাতে ছড়িয়ে পড়ে এবং চার থেকে ছয় দিন স্থায়ী হতে পারে।
আর রুবেলার লক্ষণগুলো হামের মতোই। তবে তীব্রতা মৃদু এবং র্যাশ দু-তিন দিন স্থায়ী হয়। সাধারণত এতে লসিকা গ্রন্থিও ফুলে যায়।
আরও কিছু জ্বরজারি
ওষুধজনিত কারণে জ্বর
বিভিন্ন ওষুধের অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় জ্বরসহ দেহে দানা বা র্যাশ দেখা দিতে পারে।
স্কারলেট জ্বর
জ্বর, গলাব্যথা, বমি এবং স্ট্রেপটোকক্কাস জীবাণুজনিত গলার প্রদাহ পরবর্তী টক্সিন-সৃষ্ট একটি রোগ স্কারলেট জ্বর। এতে সারা দেহে উজ্জ্বল লালচে বর্ণের র্যাশ দেখা দেয়।
সাধারণত জ্বর শুরুর দু-তিন দিন পর মুখে ও শরীরে দেখা দেয়।
কম বয়সীরা এতে বেশি আক্রান্ত হয়।
ইনফেকশাস মনোনিউক্লিওসিস
ভাইরাসজনিত এ রোগ লালা, হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে ছড়ায়।
সব বয়সে দেখা দেয় এবং জ্বরের সঙ্গে বিভিন্ন আকারের লালচে-ছোপ সারা শরীরে পাওয়া যায়।
জলবসন্ত
জ্বর, গলাব্যথা, মাথা-শরীরব্যথা শুরুর দু-তিন দিন পর লালচে আভার ওপর ফুসকুড়ি দেখা যায়, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে আসে।
হারপেস জসটার
বয়স্কদের বা যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের ভেরিসেলা জসটার নামক ভাইরাস সুপ্তাবস্থা থেকে পুনরায় আক্রমণ করে। শুরুতে স্নায়ুর বিস্তৃতি বরাবর এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বুকে ও মুখের এক পাশে তীব্র জ্বালাপোড়া ও লালচে র্যাশ হয়, পরে ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে।
বেশির ভাগ র্যাশ জ্বর সেরে যায় সঙ্গে সঙ্গে। এ জন্য আলাদা চিকিৎসার দরকার হয় না। তবে অতিরিক্ত চুলকানি থাকলে অ্যান্টি-হিস্টামিন জাতীয় ওষুধ খাওয়া যায়। এই সব দানা কখনোই নখ দিয়ে চুলকানো বা আঁচড়ানো উচিত নয়, এতে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। ত্বক পরিচ্ছন্ন ও আর্দ্র রাখতে হবে।
জ্বরে করণীয়
জ্বর হলে শরীরের বিপাকক্রিয়া বাড়ে।
তাই বাড়তি ক্যালরির প্রয়োজন হয়। অনেকে জ্বর হলে কিছু খাবেন না বলে ঠিক করেন।
এতে নিজেরই ক্ষতি।
জ্বরে সাধারণত শরীরের তাপমাত্রাকে ১০০-এর নিচে নামিয়ে আনা, তাপমাত্রাকে কমানো, গা মোছা ছাড়াও চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করা হয়।
জ্বরের সময় বেশির ভাগ মানুষেরই রুচি কমে যায়।
তাই এই সময় রোগীর খাবারের প্রতি অনীহা থাকলেও পুষ্টি উপাদানের চাহিদা পূরণে রোগীকে সঠিক খাবার-দাবার চালিয়ে যেতে হয়।
১. তরল: জ্বরের সময় যেই খাবারটির চাহিদা সবচেয়ে বৃদ্ধি পায়, সেটি হলো তরলজাতীয় খাবার। রোগীর বিপাকের হার বৃদ্ধি, শরীরের তাপমাত্রাকে স্বাভাবিকে আনা, হজমে ব্যাঘাত না ঘটানো ইত্যাদি বিষয় মাথায় রেখে তরল খাবার নির্ধারণ করা হয়। তরল হিসেবে ফলের রস, স্যুপ, লাল চা ইত্যাদি খেতে পারেন। বিশেষ করে ভিটামিন সি-যুক্ত ফল, যেমন কমলা, মাল্টা, লেবু, জাম্বুরা, আনারস ইত্যাদি। ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করবে।
২. নরম পথ্য: তরলের পাশাপাশি রোগীকে নরম বা অর্ধতরল খাবার দেওয়া গেলে ভালো। রোগীকে যেন বেশি চাবাতে না হয়, সহজে গেলা যায় এবং সহজে হজম হয়, সে জন্য নরম পথ্য নির্বাচন করতে হবে। যেহেতু তরল খাবারে ক্যালরি কম এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান কম পাওয়া যায়, তাই তরল খাবারের পাশাপাশি রোগীকে নরম খাবারও দিতে হবে। নরম পাতলা মুগ ডালের খিচুরি, জাউভাত, সুজি, সাগু, পুডিং, নরম কাঁটা ছাড়া মাছ ইত্যাদি খাবার রোগীকে দিতে পারলে ভালো।
কী কী খাবার এড়িয়ে চলা ভালো
ফাস্টফুড, ভাজাপোড়া খাবার, অতিরিক্ত শক্ত খাবার ইত্যাদি। কড়া দুধ চা ও কফি, কোল্ড ড্রিংকস এসব খাবার শুধু হজমেই অসুবিধা করে না, জ্বরে দ্রুত আরোগ্য লাভের ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করে।
তাই এ সময়টায় এ ধরনের খাবার এড়িয়ে গেলেই ভালো হয়।
Recent post
Pages
Search
শিরোনামঃ
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
Popular Posts
-
To add bangla date in your website choose below listed any HTML code and past it in your website or blog. Example1: ৪ রবিউল আউয়াল, ১...
-
অধ্যাপক ডা. তাহমীনা বেগম শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ প্রচণ্ড গরম আর তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে বৃষ্টি হচ্ছে। স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া। এই সময়ে নবজাতকসহ শুরু কর...
-
মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পড়তে পারেন বই গুলো (বই গুলো লিংক সংগ্রহীত) Thedaily71 এর স্বাধীকার রাখে না। 1. যা দেখেছি যা শুনেছি যা ক...
-
প্রসবপূর্ব সেবা একজন নারী যখন গর্ভধারন করেন তখন তার দেহে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে৷ এ সময় অনাগত শিশু ও মায়ের বিশেষ যত্ন প্রয়োজন হয়৷ একজন গর্...
-
গ্যাসের সমস্যা হলে কি করবেন, কিভাবে মুক্তিপাবেন এ সমস্যা থেকে। না আমি রান্নারগ্যাসের কথা বলছিনা। পেটের গ্যাসের যন্ত্রণায়ভোগেননি বা প্রচ...
-
আমাদের বেঁচে থাকার অন্যতম উপাদান হচ্ছে রক্ত। শরীরের মোট ওজনের শতকরা ৭ ভাগ রক্ত থাকে। আর সেই রক্তের শতকরা ৯২ ভাগই থাকে জলীয় পদার্থ দ্বারা...
-
সুষম খাদ্য (Balance diet) যে খাদ্যের মধ্যে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় সকল খাদ্য উপাদান পরিমাণমত বর্তমান থাকে, তাকেই এক কথায় সুষম খাদ্য বলা হ...
-
শিশুর স্বাস্থ্য সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে মা-বাবার উপর। কিন্তু শিশুকে ভালভাবে খাওয়ানো বেশিরভাগ মায়ের কাছে একটা সমস্যা। কারন খিদে পেলে শ...
-
সম্পর্কে সমস্যা হতেই পারে। হতে পারে তা প্রেমিক কিংবা প্রেমিকার সাথে, হতে পারে বন্ধু কিংবা কলিগের সাথে, হতে পারে স্বামী-স্ত্রী-মা-বাবা কিংবা ...
-
How to Use Safety Harnesses Effectively Your safety harnesses will only prove effective if your workers actually wear them and wear them c...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন