Recent post

মঙ্গলবার, ২ মে, ২০১৭

বিদ্যুৎ গ্রিডে বিপর্যয়



২০১৪ সালের ১ নভেম্বরের পর গত সোমবার দিবাগত রাত ও গতকাল মঙ্গলবার সকালের দুই দফা বিপর্যয়ে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিড আবারও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পড়েছে। এ কারণে নাজুক বিদ্যুৎ পরিস্থিতি প্রকট হয়ে উঠছে। জাতীয় গ্রিডের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী দুটি লাইনে এই বিপর্যয়ের কারণে দেশের প্রায় অর্ধেক এলাকায় অন্ধকার নেমে আসে।

প্রথম দফা বিপর্যয় ঘটে আশুগঞ্জ-সিরাজগঞ্জ ২৩০ হাজার ভোল্ট লাইনে, প্রাকৃতিক (কালবৈশাখী) কারণে। ঘোড়াশাল-ঈশ্বরদী লাইনে দ্বিতীয় দফা বিপর্যয়ের কারণ ‘কারিগরি ত্রুটি’। এ ধরনের ঘটনার প্রকৃত কারণ জানা না গেলে সাধারণত ‘কারিগরি ত্রুটি’ বলা হয়ে থাকে।

এই বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে পিজিসিবির প্রধান প্রকৌশলী (সঞ্চালন-২) কামরুল হাসানকে প্রধান করে চার সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। কমিটিকে পাঁচ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

দুই দফা গ্রিড বিপর্যয়ের কারণে রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ৩৮টি জেলার অনেক এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। ওই অঞ্চলের প্রায় ২৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। গতকাল বেলা দুইটা নাগাদ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু হয়েছে। সন্ধ্যা নাগাদ বিকল্প ব্যবস্থায় প্রায় সব এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে। তবে ঢাকার পার্শ্ববর্তী ভৈরবে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা যায়নি।

বিদ্যুৎ গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) সূত্রগুলো বলেছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হলেও গ্রিডের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার অবসান হয়নি। কারণ গত সোমবার রাতের প্রচণ্ড ঝড়ে বিদ্যুৎ গ্রিডের একটি টাওয়ার সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে গেছে। জাতীয় গ্রিডের আশুগঞ্জ-সিরাজগঞ্জ ২৩০ হাজার ভোল্টলাইনে আশুগঞ্জের কাছে মেঘনা নদীর মধ্যে ওই টাওয়াটির (রিভার ক্রসিং টাওয়ার) অবস্থান।

ঝড়ে টাওয়ারটি এমনভাবে দুমড়ে-মুচড়ে গেছে যে সেটি প্রতিস্থাপন না করে আর ব্যবহার সম্ভব হবে না। আবার টাওয়ারটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের হওয়ায় এর প্রতিস্থাপন সহজ নয়, কয়েক মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এই সময়ে বিকল্প ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু রাখা যাবে। তবে তা ঝুঁকিমুক্ত হবে না। যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে সমস্যা দেখা দিতে পারে। ফলে পিজিসিবিকে সব সময় একটা ভয়ের মধ্যে থাকতে হবে।

ওই টাওয়ারের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য গতকাল পিজিসিবির একটি বিশেষজ্ঞ দল আশুগঞ্জে গেছে। দলটি টাওয়ারটির নকশা দেখে নতুন করে তা তৈরির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। এ ছাড়া টাওয়ারটির ভিত্তিতে (ফাউন্ডেশন) কোনো সমস্যা হয়েছে কি না, তা-ও তারা পরীক্ষা করে দেখবে। এটি কোরিয়ার তৈরি। স্থানীয়ভাবে এটি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। সে ক্ষেত্রে এটি প্রতিস্থাপনে কয়েক মাস সময় লাগবে। ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে সময় আরও বেশি লাগতে পারে।

বিদ্যুৎ গ্রিডে দ্বিতীয় দফায় বিপর্যয় ঘটে গতকাল সকালে, ঘোড়াশাল-ঈশ্বরদী লাইনে কারিগরি কারণে। লাইনটি গতকাল বিকেল থেকে পূর্ণ ক্ষমতায় চলছে। এই লাইনের মাধ্যমে দেশের পূর্বাঞ্চল থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পশ্চিমাঞ্চলে (যমুনা নদীর পশ্চিম পাড়ে) সরবরাহ করা যায়। আর আশুগঞ্জ-সিরাজগঞ্জ লাইনটি দিয়ে করা যায় ৭০০ মেগাওয়াট। এই বেশি ক্ষমতার লাইনটিরই টাওয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই এটি পূর্ণ ক্ষমতায় কবে নাগাদ চালু করা যাবে, তা অনিশ্চিত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, প্রাকৃতিক কারণে দুর্ঘটনার ওপর তো কারও হাত নেই। তবে এ কথাও ঠিক যে গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সেই তুলনায় সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থার উন্নয়ন গুরুত্ব কম পেয়েছে। এখন এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা জরুরি। আর অন্য সঞ্চালন টাওয়ারগুলোর অবস্থাও পরীক্ষা করে দেখা উচিত।

পরিকল্পনায় থাকলেও বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালনব্যবস্থার উন্নয়নে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারেনি সরকার। গত সাত-আট বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ৫ হাজার মেগাওয়াট থেকে বেড়ে প্রায় ১৫ হাজারে উন্নীত হয়েছে। এই সময়ে সঞ্চালন লাইন ও গ্রিড উপকেন্দ্রের ক্ষমতা অনেক বেড়েছে। ১৩২ ও ২৩০ হাজার ভোল্টের সঞ্চালন লাইন পর্যায়ক্রমে ৪০০ হাজার ভোল্টে উন্নীত করে নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত জাতীয় গ্রিডকে সব বিদ্যুৎ সঞ্চালন করার মতো নির্ভরযোগ্য করে তোলা যায়নি।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জাতীয় লোড ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রের (এনএলডিসি) আধুনিকায়ন করা হয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের সঙ্গে এর সমন্বয়ের অভাব এখনো রয়েছে। তা ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালনের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা পর্যায়ে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এটিও এখন পর্যন্ত বড় সমস্যা হয়েই আছে।

বিষয়টি সম্পর্কে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎ গ্রিডে অনেক কারণেই সমস্যা হতে পারে। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গ্রিডের উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত আছে। সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য গ্রিড-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আরও তিন-চার বছর সময় লাগবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুৎব্যবস্থায় গ্রিড একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর অঙ্গ। গ্রিড বন্ধ হয়ে বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটার অনেক কারণ আছে। অতি পুরোনো ও জরাজীর্ণ সঞ্চালন লাইনে (গ্রিড) যদি এর ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালিত হয়, তাহলে গ্রিডের সার্কিট পুড়ে বিপর্যয় ঘটতে পারে। সঞ্চালন লাইনে যদি ছিদ্র দেখা দেয়, তা থেকে স্পার্ক করে গ্রিড বন্ধ হতে পারে। বিদ্যুৎ সঞ্চালনের ফ্রিকোয়েন্সিতে হেরফের হলে গ্রিড বন্ধ হতে পারে। এমনকি চালু বা সক্রিয় অবস্থায় সঞ্চালন লাইনে কোনো পাখি বসলে কিংবা কোনো গাছ বা গাছের ডালপালা ভেঙে পড়লেও গ্রিড বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

গতকাল যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে দেশের পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ পাঠানোর দুটি লাইন বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে ওই অঞ্চলের জেলাগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়।

ভৈরব থেকে সুমন মোল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে শাহাদৎ হোসেন জানান, কালবৈশাখীতে জাতীয় গ্রিড লাইনের কিশোরগঞ্জের ভৈরবের একটি টাওয়ার বিধ্বস্ত এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের আরেকটি টাওয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত সোমবার রাত নয়টার দিকে এ ঘটনার পর থেকে বিদ্যুৎ সঞ্চালন বন্ধ রয়েছে।

২৩০ কেভি ক্ষমতাসম্পন্ন আশুগঞ্জ-সিরাজগঞ্জ জাতীয় গ্রিডলাইনের দুটি টাওয়ারের একটি ভৈরব পৌর শহরের কালিপুর এলাকার মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত। ঝড়ে টাওয়ারটি ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে মাটিতে পড়ে রয়েছে।

বিদ্যুৎ গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি) সূত্রে জানা গেছে, বিকল্প ব্যবস্থায় আশুগঞ্জ-ঘোড়াশাল-ঈশ্বরদী গ্রিডলাইন দিয়ে সিরাজগঞ্জসহ আশপাশের জেলার আংশিক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। পিজিসিবির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ভৈরব অংশে ক্ষতিগ্রস্ত টাওয়ারটি জাতীয় গ্রিডলাইনের রিভারক্রসিং টাওয়ার। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, বেশির ভাগ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে বিকল্প গ্রিডলাইন সচল থাকায় সঞ্চালনব্যবস্থায় তেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি।

ঝড়ে ভৈরবে দুই শতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। অসংখ্য গাছপালা উপড়ে পড়েছে। উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের শম্ভুপুর গ্রামের বাবুল মিয়া (৫৫) নামের এক ব্যক্তি ছিঁড়ে পড়া তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নিহত হন। পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সীমানাদেয়াল ভেঙে গেছে।

ঝড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ সদর উপজেলার চর সোনারামপুর গ্রামে গ্রিডলাইনের তার মেঘনা নদীতে পড়ে যায়। ফলে আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের চালু সব ইউনিটে উৎপাদন কমানো হয়েছে।

কাল বিকেলে আশুগঞ্জের মেঘনা নদীর মাঝখানে অবস্থিত চর সোনারামপুর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, জাতীয় গ্রিডের টাওয়ারের বেশ কিছু নাটবল্টু ভেঙে নিচে পড়ে রয়েছে। টাওয়ারের বেশ কিছু নাটবল্টু খুলে যাওয়ায় বিভিন্ন অংশ ফাঁকা হয়ে গেছে।

পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমানে বিকল্প ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎ লাইন দিয়ে জাতীয় গ্রিডে ২০০-২৫০ কেভি বিদ্যুৎ যোগ হতো। একটি প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

সৈয়দপুর (নীলফামারী) প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরের পার্বতীপুরে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশে বড়পুকুরিয়া ২৩০, ১৩২, ৩৩ কেভি গ্রিড সাবস্টেশনের একটি ট্রান্সফরমার বিস্ফোরিত হলে উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিপর্যয় দেখা দেয়। তবে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু হয়।

বড়কুপুরিয়া বিদ্যুৎ গ্রিড সাবস্টেশনের রক্ষণাবেক্ষণ কর্মকর্তা উপসহকারী প্রকৌশলী জাহিদ হোসেন বলেন, বগুড়া, রংপুর ও সিরাজগঞ্জের জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত এই সাবস্টেশনে হঠাৎ হাইভোল্টেজ সৃষ্টির কারণে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর কারণ উদ্‌ঘাটনে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

Popular Posts