২০১৯ সালের জানুয়ারির মধ্যে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে একটি পথনকশা (রোডম্যাপ) তৈরি করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তাতে নির্বাচনী আইন সংশোধন, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, দল নিবন্ধন ও আগামী জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয় রয়েছে। এসব বিষয়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও নাগরিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করবে কমিশন। পথনকশা অনুযায়ী, আগামী জুলাইয়ে এই সংলাপ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থক দলগুলো কমিশনের এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছে। তারা বলছে, এই উদ্যোগ সবার অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নির্বাচনের এই সংলাপের উদ্দেশ্য ও সফলতা নিয়ে সন্দেহ, সংশয় প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, নতুন নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত নিরপেক্ষতা ও দক্ষতা দেখাতে পারেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের উদ্দেশ্য যদি লোক দেখানো হয় এবং সরকারের বক্তব্য তুলে ধরা হয়, তাহলে সেটি কোনো কাজে আসবে না। তবে দলটি সংলাপে অংশ নেওয়ার পক্ষে।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, পথনকশাটি এখন কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। পথনকশায় জুনে কাজ শুরুর সময় ধরা হয়েছে। মূল কাজগুলো জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত চলবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। সেটা শুরু হবে জুলাইয়ে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বলেন, নির্বাচন কমিশনের প্রধান অংশীজন হলো রাজনৈতিক দল। তাই দলের সঙ্গে সংলাপ হওয়া জরুরি। এর মাধ্যমে দলগুলোর নির্বাচনী ভাবনা ও ইসির কাজের বিষয়ে কোনো সমস্যা থাকলে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হওয়া সম্ভব। নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণ পেলে আওয়ামী লীগ সংলাপের আলোচ্যসূচি (অ্যাজেন্ডা) তৈরি করবে। তিনি বলেন, নির্বাচনী আইন সংশোধন দরকার। নির্বাচনে প্রযুক্তির ব্যবহারে পরিবর্তন এসেছে। তাই নতুন চিন্তা বাস্তবায়ন ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংলাপ জরুরি।
অবশ্য বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁর দল সংকট সমাধানে আলোচনায় বিশ্বাস করে। সংলাপ একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলে বিএনপি অংশ নেবে। তিনি বলেন, এককভাবে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব নয়। এ কারণে বিএনপি নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলছে।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, বর্তমান কমিশন তাঁদের দলের কাছে এখনো বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে তারা দক্ষতা দেখাতে পারেনি। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস জন্মেনি। নির্বাচন কমিশন সরকারের মুখপাত্র হয়ে, নাকি সত্যিই সংকট সমাধান, রাজনৈতিক দলের আস্থা অর্জন ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংলাপ করছে, সেটা দেখার বিষয়। তিনি বলেন, দেখা যাক নির্বাচন কমিশন কী উদ্দেশ্যে কী উদ্যোগ নেয়।
কমিশন সচিবালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা ও একজন কমিশনার বলেছেন, বিগত দুটি কমিশনের কাজের ধরন বিশ্লেষণ করে পথনকশা করা হয়েছে। এ টি এম শামসুল হুদার কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ১ বছর সাড়ে ১০ মাস সময় পেয়েছিল। তারা একটি পথনকশা করে কাজগুলো শেষ করেছিল। ফলে জাতীয় নির্বাচনের আগে সব কাজ যেমন শেষ হয়েছিল, তেমনি নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে ওই কমিশনকে তেমন ঝামেলায় পড়তে হয়নি। এরপর কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ কমিশনের সময় জাতীয় নির্বাচনের জন্য কোনো পথনকশা ছিল না।
চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব নেয় কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন। কমিশনের অপর সদস্যরা হলেন মাহবুব তালুকদার, মো. রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও শাহাদাত হোসেন চৌধুরী।
জাতীয় নির্বাচন কবে
পথনকশা অনুযায়ী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা ২০১৮ সালের ডিসেম্বর বা ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। সে ক্ষেত্রে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর বা তারপরে তফসিল ঘোষণার জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।
কমিশন বলছে, সংবিধানে এই সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন আগের যেকোনো দিন ভোট হতে পারে। দশম সংসদের মেয়াদ শুরু হয় ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি।
সংলাপ ও আইন সংশোধন
নির্বাচন কমিশনের করা পথনকশায় নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, নাগরিক প্রতিনিধি, গণমাধ্যম ও নির্বাচনসংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে এক দফা, সম্ভব হলে দুই দফা আলোচনা বা সংলাপ করার কথা বলা হয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) অস্পষ্ট এবং অপ্রাসঙ্গিক ধারাগুলো বাতিল বা সংশোধন করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
কমিশন সূত্র জানায়, চলতি বছরের জুন থেকে আইন সংশোধনসংক্রান্ত প্রস্তাব তৈরির মধ্য দিয়ে কাজ শুরু হবে। আইনের একটি খসড়া সংশোধনী তৈরি করে সেটি নিয়ে প্রথম দফায় সংলাপ শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে সংলাপে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দল, নাগরিক প্রতিনিধি ও গণমাধ্যমের মতামত নেওয়া হবে। জুন থেকে পথনকশা অনুযায়ী চলা শুরু হলেও মূলত ভোট পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো অংশীজনদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে করা হবে।
নির্বাচন কমিশন সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, আইনের কিছু ধারা আছে, যা এখন বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, সেগুলো সংশোধন করা দরকার। ভালো নির্বাচনের জন্য আইনে নতুন কোনো ধারা যুক্ত করতে হবে কি না, সেটাও দেখতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নির্বাচন কমিশনার বলেন, ইতিমধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করে কিছু আইন পরিবর্তন, সংস্কার চেয়েছেন। কমিশনও মনে করে, কোনো কোনো আইনের সংস্কার প্রয়োজন। নতুন ধারাও সংযোজন দরকার।
অংশীজনদের মত হতে হবে সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ
কমিশনের কর্মকর্তারা বলেন, আগামী নির্বাচন হবে বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী। অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনের সময় বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারই দায়িত্ব পালন করবে। এ কারণে সংলাপের সময় এটি মাথায় রেখে অংশীজনদের প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে। সংবিধানবহির্ভূত কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে না।
ওই কর্মকর্তারা আরও বলেন, অবধারিতভাবেই কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি সংলাপে নির্দলীয় বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি তুলবেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কমিশনের বক্তব্য শোনা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। তাই মূল কথা বলার জন্য আগে থেকেই অনুরোধ জানিয়ে রাখা হবে।
জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, একটি কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করলে কাজগুলো গোছানো হয়। কমিশনের প্রধান অংশীজন হলো রাজনৈতিক দল। এ কারণে তাদের সঙ্গে বারবার আলোচনা খুবই জরুরি। এতে কমিশনের ওপর দলগুলোর আস্থা বাড়বে। সন্দেহ-দূরত্ব দূর হবে। তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ী আগামী নির্বাচন ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে হবে। তাই ওই নির্বাচন সুষ্ঠু-অবাধ করতে প্রয়োজনে কিছু আইনে সংস্কার আনা যেতেই পারে।
সাবেক এই নির্বাচন কমিশনারের মতে, নির্বাচন কমিশনকে আগে আস্থা অর্জন করতে হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর মাধ্যমে তাদের সেই চেষ্টা করা দরকার। কমিশনকে নিয়ে দলগুলোর সন্দেহ-অবিশ্বাস থাকলে সংলাপ সফল হবে না।