Recent post

মঙ্গলবার, ৯ জানুয়ারী, ২০১৮

রফতানি চাহিদা বিলিয়ন ডলার




শফিউল আলম : 
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী রফতানি পণ্য পাট, চা, চামড়ার বাজার প্রায় হারিয়ে গেছে। বিশ্বখ্যাত মসলিন কাপড় এদেশের হারানো সমৃদ্ধ অতীতের এক দীর্ঘশ্বাস। ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রাম শহরের কালুরঘাট শিল্প এলাকায় স্থাপিত ‘দেশ গার্মেন্টস’ দিয়েই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানির পথচলা। 
তবে শুরুতে কে জানতো এই শিল্প আজ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে? অপরদিকে দেশের সাগর-উপকূল ও নদী অববাহিকায় প্রকৃতির অনুকূল অবকাঠামো সুবিধা, জাহাজী প্রকৌশলী-কারিগরদের বৃদ্ধি-অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে জাহাজ-নির্মাণ শিল্পখাতের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ নিশ্চিত করা হলে বিলিয়ন ডলার আয়ের অবারিত দুয়ার খুলে যাবে। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের জাহাজ-নৌযান, ট্যাংকার, ট্রলার, যুদ্ধ জাহাজ, প্রমোদতরী, ফেরি, বিশেষায়িত জাহাজ-কোস্টার এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানির চাহিদা রয়েছে। ফলে জাহাজ রফতানি বাবদ আয় নিশ্চিতভাবেই গার্মেন্টসের আয়কেও অতিক্রম করে যেতে পারে। তবে এরজন্য প্রয়োজন জাহাজ-নির্মাণ শিল্পখাতকে সবল করার লক্ষ্যে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এবং মহাপরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে এর সুষ্ঠু বিকাশ নিশ্চিত করা। এহেন দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন চিটাগাং ড্রাইডকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহাজ-নির্মাণ শিল্পখাতের বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী এনামুল বাকি, প্রকৌশলী এম সাখাওয়াত হোসেন এবং সংশ্লিষ্ট মেরিন প্রকৌশলী, শিল্পোদ্যোক্তারা।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, জাহাজ নির্মাণ শিল্পখাতে রয়েছে অফুরান অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। যার বর্তমানে আংশিকমাত্র কাজে লাগানো হচ্ছে। এই খাত উপেক্ষার শিকার। অথচ উচ্চহারে মজুরিসহ নানাবিধ কারণে জাহাজ নির্মাতা উন্নত দেশগুলোতে শিপইয়ার্ড বন্ধ হওয়ায় বাংলাদেশের সামনে খুলে গেছে বিরাট সুযোগ। জার্মানী, ডেনমার্ক, ব্রিটেনের মতো জাহাজ নির্মাণকারী দেশগুলো গত এক-দেড় দশকে একে একে বন্ধ করে দিয়েছে ইয়ার্ড। গুটিয়ে নিয়েছে জাহাজের রাজসিক বাণিজ্য। 
উল্টো এসব বনেদী নির্মাতাই এখন জাহাজ কিনছে ভিনদেশে ঘুরে ঘুরে। তাদের চোখে পড়েছে বাংলাদেশের পারদর্শিতা। সমৃদ্ধ অঙ্গনে প্রবেশের জন্য উপযুক্ত প্রস্তুতিই সময়ের ব্যাপার মাত্র। বাংলাদেশী দক্ষ ও বহুমাত্রিক জ্ঞানসম্পন্ন মাস্টার মেরিনার, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, নটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, নেভাল আর্কিটেক্ট, বিভিন্ন পর্যায়ের প্রকৌশলী ও কারিগর রয়েছেন। যারা বহির্বিশ্বে নৌ-প্রকৌশল ও শিপিং ক্ষেত্রে নিবিড় যোগাযোগের মাধ্যমে জাহাজনির্মাণ শৈলী সম্পর্কে যথেষ্ট আত্মপ্রত্যয়ী এবং পারদর্শী। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া জাহাজ নির্মাণ শিল্প থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগটি দ্রæত আয়ত্ত করে নেয় চীন ও ভিয়েতনাম। 
এখন ভিয়েতনামে বৃহাদাকার জাহাজ তৈরির অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। 
১ লাখ টন ধারণক্ষমতার জাহাজ নির্মাণে সক্ষম ভিয়েতনাম। সেখানকার সবক’টি ইয়ার্ড ২০২১ সাল পর্যন্ত বুকড।
নতুন জাহাজের অর্ডার দেয়ার জন্য ক্রেতারা ঝুঁকছে বাংলাদেশের দিকে। বিশ্বে শিপিং বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সমানুপাতে ছোট ও মাঝারি আকারের জাহাজের চাহিদা বেড়েছে। বাংলাদেশের জন্য তা সবচেয়ে উপযোগী। চলতি ২০১৮ থেকে ২০২১ সালে বিশ্বে কমপক্ষে সাড়ে ৫শ’ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ছোট ও মাঝারি আকৃতির সমুদ্রগামী জাহাজের চাহিদা রয়েছে। এরমধ্যে আছে হাইস্পিড ভেসেল, সার্ভিস টাগ, কন্টেইনার ফিডার জাহাজ, ওশেন গোয়িং টাগ, অয়েল ট্যাংকার, কোস্টার, লঞ্চ-স্টিমার, প্রমোদতরী, যুদ্ধ জাহাজ, ফেরি, টাগসহ বিভিন্ন ধরনের নৌযান। এ বিপুল পরিসরের চাহিদার মধ্য থেকে মাত্র ১ শতাংশ পরিমানও যদি বাংলাদেশ অর্ডার বা ফরমায়েশ নিতে পারে তাহলে জাহাজ নির্মাণ শিল্প-বাণিজ্য খাত থেকে একবছরে ৫৫০ কোটি ডলার অনায়াসে আয় আসবে। বিশ্বে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৩ হাজার মাঝারি আকারের সমুদ্রগামী জাহাজ নৌযান তৈরি হচ্ছে। জাহাজ নির্মাণ একটি শ্রমনিবিড় খাত। এ খাতে দেশের কয়েক লাখ লোকের নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। এ শিল্পের সুষ্ঠু বিকাশ ঘটলে এককভাবে জিডিপি ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণ এবং নির্মিত জাহাজ রফতানির চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। ইতোমধ্যে ইউরোপ, আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশের ক্রেতা, এজেন্ট ও ব্রেকাররা বাংলাদেশে তৈরি সমুদ্রগামী কার্গোজাহাজ ক্রয় করেছে। 
রফতানি অর্ডার অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান সময় বিগত ৫ বছরে ২৯টি মাঝারি ও ছোট আকারের জাহাজ রফতানির মাধ্যমে প্রায় ১৫৫ কোটি ডলার মূল্যের রেমিটেন্স আয় এসেছে। আরও প্রায় ১৪০ কোটি ডলার মূল্যের জাহাজ কেনার আগ্রহ দেখানো হয়েছে বিভিন্ন দেশের ক্রেতাদের পক্ষ থেকে। এসব জাহাজ রফতানি হচ্ছে ডেনমার্ক, লিবিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, হল্যান্ড, মোজাম্বিক, পর্তুগাল, জার্মানীসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। এরমধ্যে বেশিরভাগই আইসক্লাস, সমুদ্রগামী এমপিসি জাহাজ। দেশীয় ইয়ার্ডসমূহের নির্মিত জাহাজবহরের প্রযুক্তি ও কারিগরি মানের নিশ্চয়তা সম্পর্কে জিএল, এবিএস, বিভিসহ বিশ্বখ্যাত ক্লাসিফিকেশন সোসাইটি কর্তৃক ছাড়পত্র প্রদান করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে সীমিতভাবে রফতানি হলেও সমুদ্রগামী মার্চেন্ট জাহাজ এমনকি যুদ্ধজাহাজ নৌযানের মানসম্মত নির্মাণ ও রফতানিকারক নতুন দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ ঠাঁই করে নিয়েছে। এখনও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে এই খাতটি। অস্ত্রশস্ত্র ও ভোগ্যপণ্যের পর বিশ্বের সেরা এবং প্রাচীন ব্যবসায় খাত হচ্ছে জাহাজ নির্মাণ। বাংলাদেশে তৈরি জাহাজ কেনার জন্য ডেনমার্ক, জার্মানী, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে ও আফ্রিকান কয়েকটি দেশ থেকে সরবরাহ অর্ডার (ফরমায়েশ) আসছে। তবে ইয়ার্ডসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো, শিল্প প্রসারে সহায়তা ও প্রণোদনা সুবিধা সঙ্কুচিত থাকায় চাহিদার তুলনায় বাজার আয়ত্তে আনা সম্ভব হচ্ছে না।
বর্তমানে অথনৈতিক মন্দা সত্তে¡¡ও দেশের শীর্ষস্থানীয় জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ২৫টি জাহাজ নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সেগুলো রফতানি হবে নরওয়ে, ডেনমার্ক, কেনিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, গামবিয়া ও ভারতে। আগামী এক বছরে রফতানিমুখী সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা মূল্যের জাহাজ নৌযান নির্মাণের কাজ চলবে। এই আয় দ্বিগুণ-তিনগুণ করা অনায়াসে সম্ভব। জাহাজ রফতানিতে মূল্য সংযোজন আয়ের হার ৩৪ থেকে ৩৮ শতাংশ। ইউরোপ ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশ তাদের নতুন জাহাজ নির্মাণের জন্য বাংলাদেশে যোগাযোগ করছে, অর্ডারও দিচ্ছে। অব্যাহত বাজার চাহিদা সামনে রেখে জাহাজ শিল্প মালিকরা আশা করছেন, বর্তমান পর্যায়ে বার্ষিক ৩৪টি জাহাজ বাংলাদেশের ইয়ার্ডসমূহে নির্মিত হবে। যার মূল্য প্রায় ২ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা।
Inqilab Logo

কোন মন্তব্য নেই:

Popular Posts