Recent post

সোমবার, ১২ জুন, ২০১৭

রাজার পাহাড় গল্প

ঘুম থেকে উঠে বাইরে এসে মনটা ভরে গেল। রাতের ঝড়-বৃষ্টি সবকিছু ঝেড়ে-মুছে একেবারে ধুয়ে দিয়ে গেছে। আয়নার মতো ঝকঝক করছে রাস্তার পিচ। চকচক করছে ভবনের দেয়াল ও গাছপালা। সকালটা অবাক এক শিশুর মতো বড় বড় চোখে আমার দিকে বোকা বোকা তাকিয়ে আছে। যেন সে বিশ্বাসই করতে পারছে না পরিস্থিতিটা হঠাৎ এমন বদলে গেল কীভাবে।

গত কয়েক দিনের ঘটনা আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না। এত দিনের সংঘাতের পর হঠাৎ সবকিছু অদ্ভুত শান্ত। বিরোধীরা গুটিয়ে নিয়েছে নিজেদের। প্রতিপক্ষের ধাক্কায় ছিটকে পড়তে পড়তে টিকে যাওয়া সরকার দলেরও কোনো কাউয়া-কীর্তন নেই। বিনা রক্তপাতে বিরোধীদের এমন টাইট দেওয়ার সাফল্যে তারা একটু উল্লাস করলেই স্বাভাবিক হতো। তা না করে চুল-দাড়ি-গোঁফ সাদা বুড়ার মতো চুপচাপ খুব খোশমেজাজে বসে এক আঙুলে তাল ঠুকছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। মনে মনে কী এক কুটিল ছক কষছে যেন।

সকালে স্ত্রীকে নিয়ে হাঁটতে বের হওয়া রোগা দেহের মধ্যবয়সী লোকটা আমার পাশ দিয়ে যেতে যেতে আস্তে করে বললেন, ‘যাক, বাঁচা গেল! বহু দিন পর সকালে নিশ্চিন্তে একটু হাঁটা তো যাচ্ছে।’ আমাকে শোনানোর জন্য তিনি তা বলেননি। স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই হাঁটছেন তিনি। আমি তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। তাঁদের এই অল্পে খুশির স্বস্তিটাই আমার অস্বস্তি হয়ে দাঁড়াল। আমার আর হাঁটতেই ইচ্ছা করল না।

বাসায় ফিরেও মন বসছিল না। ‘কী করি কী করি’ করতে করতে কখন যে কাঁধের ব্যাগ আর স্যুটকেসটায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, আর কখন এখানে এসে পৌঁছলাম, কিছুই বলতে পারছি না।

যেখানে এসেছি, তা একেবারেই আকাট একটা পাহাড়ি জঙ্গল। পর্যটকদের হুমড়ি খেয়ে পড়ার মতো কোনো সুযোগ-সুবিধাই নেই। এখানে প্রকৃতি এখনো একেবারে অগা-মগা। তারপরও গত দুই দিনে এক-দুই করে বাড়তে বাড়তে বেড়াতে আসা লোকজন শ ছাড়িয়ে গেছে।

পত্রিকার বড় সাংবাদিক আর তাঁর অধ্যাপক স্ত্রীকে এখানে পাব ভাবিনি। পাহাড়ি টিলা থেকে নেমে যাওয়া মাটির রাস্তায় হাত ধরাধরি করে হাঁটতে হাঁটতে সাংবাদিক বললেন, ‘লোকজন তো দেখি খুব চাল্লু। বুড়ো বয়সে এই পাহাড় আর জঙ্গলে দুজনে নিবিড় খুনসুটি করব ভাবলাম। এখানেও দেখি ভিড়। এখানেও তারা আমাদের চাইতে এগিয়ে আছে।’

সাংবাদিক এমন মনমরা হয়ে বলছিলেন যে তাঁর কথার রসটা আমি প্রথমে টের পাইনি। মুখ লাল করে স্ত্রী যখন তাঁকে কনুইয়ের খোঁচা দিলেন, তখন বুঝতে পারলাম। হাসতে হাসতে আমিও ফোড়ন কাটলাম, ‘পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সে মানুষ নিজেকে বুড়ো ভেবে মজা পায়। তারা যে নিজের বুড়োমি নিয়ে গোপনে গোপনে নিরীক্ষা চালায়, তা তো জানতাম না।’

সাংবাদিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কয়েক বছরের সিনিয়র ছিলেন। তখন তাঁরা দাম্পত্য শুরু করেছেন মাত্র। প্রায় দশ বছর তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। সেই সময়ে হলে সাংবাদিক বলতেন, ‘বুঝবা কেমনে, বিয়া তো করো নাই। বিয়াটিয়া না করলে তো বয়স বাড়ে না। দাম্পত্য যে তলে তলে কত রকম, তা কি তোমরা জানো?’ এখন তিনি নীরস গলায় বললেন, ‘বিয়েটিয়ে তাহলে আর করলেই না।’

সাংবাদিক আর অধ্যাপক সরকারের বিরোধিতায় ছিলেন। আমি তাঁদের লেখা পড়েছি। টেলিভিশনে বক্তব্য দিতে দেখেছি। বিরোধী দলগুলো গুটিয়ে যাওয়ার পর তাঁদের মতো সোচ্চার সুশীলদেরও হয়তো এই রকম তীর্থযাত্রা ছাড়া কিছুই করার নেই। সুশিক্ষিত মানুষ যখন দলীয় লোকজনের মতো বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করতে গিয়ে যুক্তি ও চিন্তা দিয়ে গোঁয়ার্তুমি করে, তখন আমার খুব বিরক্ত লাগে। কিন্তু গত দুই দিনে তাঁকে এমন মিইয়ে যাওয়া অবস্থায় দেখে আমার মনটাও নরম হয়ে গেছে। অধ্যাপকই আমাকে গতকাল বলছিলেন, ‘এখানে এসে তোমাকে পেয়ে ও বোধ হয় একটু হালকা হয়েছে।’

দশ বছরেও সাংবাদিকের চেহারায় তেমন কোনো বদল নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকও আগের মতো হালকা-পলকা। পাহাড়ে ওঠার ব্যাপারটা তাঁদের গায়েই লাগছে না। আমিও তাঁদের সঙ্গে উঠছিলাম। এসব অ্যাডভেঞ্চার যে আমার খুব ভালো লাগে, তা নয়। তারপরও আমি উঠছিলাম তাঁদের দেখাদেখি। অনেকটা তাঁদের আনন্দেই আমিও আনন্দ পাচ্ছিলাম।

পাহাড়ে এসে এই দেখায়ই জানলাম যে তাঁরা প্রায়ই বেড়াতে বের হন। কখনো কখনো ছেলেমেয়ে দুটোও সঙ্গে থাকে। আমিও বের হই। তবে খুব একটা না। বেড়াতে-টেড়াতে আমার খুব ইচ্ছা করে না। এখানেও এসে পড়েছি নিজের অজান্তেই। আমি আসলে শহর ছেড়ে কোথাও যেতে চেয়েছিলাম। ব্যস! ইচ্ছা-অনিচ্ছার মাঝখানে দুলতে দুলতে এখানে চলে আসা। ঠিক যেভাবে এখানে এসে পড়েছি, সেভাবেই, দোটানায় থেকেই এই দম্পতির পাল্লায় পড়ে পাহাড়ে উঠছি। ‘খাড়ি বেয়ে পাহাড়ে ওঠা খুব সহজ না। ছোটবেলায় সুপারি, নারকেল বা তালগাছ বেয়ে চূড়ায় ওঠার মতোই কঠিন।’ হাঁপাতে হাঁপাতে পাহাড়ের চূড়ায় ধপাস করে বসে অধ্যাপক তা-ই বলছিলেন।

ক্লান্তি ও কষ্টে আমারও ঘাম ছুটে গেছে। নিজের দম সামলে নিতে নিতে বললাম, ‘ভাবি তো মনে-প্রাণে অ্যাকটিভিস্ট। রাজপথে এখনো ছাত্রীদের মতো দৌড়ঝাঁপ করেন। আমার তো এই ঢাল বেয়ে উঠতেই দম বেরিয়ে গেছে। ভাগ্যিস মাঝপথে হাল ছেড়ে দিই নাই। কী সাংঘাতিক ব্যাপার হতো তাহলে!’

অধ্যাপক বললেন, ‘আরে ধুর, কিচ্ছু হতো না। পড়ে যেতে? পড়তে না। নিচে পড়লে যে বাঁচবে না, এটা জেনেই তুমি জান থাকতে পড়তে না।’

অধ্যাপকের কথায় সাংবাদিকের কাছে একটা বিষয়ে জানার ইচ্ছা হলো। আমি জানি, তিনি পরাজয় সহজভাবে নিতে পারেন না। ‘গত কয়েক বছরের রাজনৈতিক সংগ্রামের এই যে চূড়ান্ত বিপর্যয়, এটাকে কীভাবে নিচ্ছেন?’ জানতে চাইলাম। হাসতে হাসতে তিনি বললেন, ‘এ ব্যাপারে তুমি আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে যেমন জানতে, এখনো তেমনই আছি।’

সাংবাদিককে কথা শেষ করতে দিলেন না অধ্যাপক। তিনি হয়তো ভাবলেন, আমার প্রশ্নে সাংবাদিকের বিষণ্নতা আরও বেড়ে যেতে পারে। অধ্যাপক ঝটপট বলে উঠলেন, ‘আমার কাছে ব্যাপারটা ভিন্ন। নিজেকে আমি বিজয়ী বা বিজিত ভাবতে পারিনি কোনো দিন। সব সময় মনে হয়েছে সাধারণ মানুষ আমরা। লড়াইয়েই আমাদের সার্থকতা। জিতলাম না হারলাম, সেটা বড় না, বরং যখন সরকারের বিরুদ্ধে একটা পদক্ষেপ নিয়েছি, যে পদক্ষেপ সবার নজর কেড়েছে, কাউকে কাউকে উদ্বুদ্ধ করেছে, তখনই আমার মনে হয়েছে, আমি জিতে গেছি। জনগণ হিসেবে এইটুকু জয়েই আমি সব সময় আমার সার্থকতা দেখি।’

বললাম, ‘আপনার এই অল্পে খুশিই কিন্তু আমাদের ক্ষমতামুখী রাজনৈতিক দলগুলোকে জিতিয়ে দেয়। আপনি কেবল সিস্টেম আর ইস্যুর মধ্যে থাকেন। ইস্যুতে জয় হলেই খুশিতে ফিরে যান। আপনার সন্তুষ্টি ও ক্ষোভের সঙ্গে জনগণের বেশ মিল আছে। অধিকাংশ মানুষের মনোভাবও বোধ হয় আপনার মতোই। যে কারণে টেলিভিশনে যখন আপনি কথা বলেন, লোকজন আপনাকে খুব পছন্দ করে।’

সাংবাদিক স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার মতো পারলে ভালো হতো। এই যেমন তুমি, যেমনই হোক, একজন বিজয়ীর মনোভাব নিয়ে বেড়াতে এসেছ আর আমি পরাজিতের।’

তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলা শুরু করলেন। যেন প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে চাইলেন। আমিও আর এগোলাম না। প্রচলিত রাজনীতি নিয়ে আমার খুব বেশি আগ্রহও নেই। সাংবাদিক ও অধ্যাপক এর মধ্যে তা টের পেয়েছেন। তাঁদের কথার মাঝখানে সাংবাদিকের কাছ থেকে বাইনোকুলারটা নিয়ে আমি অযথাই চারদিকে দেখতে থাকলাম।

সাংবাদিক বললেন, ‘রাজনীতি নিয়ে তোমার আগ্রহ তো ওপরে ওপরে। বাইনোকুলারে নিসর্গ দেখায়ও দেখছি তা-ই।’ আমি হাসলাম। বললাম, ‘এই রকম একটা টিলায় দাঁড়িয়ে আসলে কীই-বা আর দেখার আছে!’ তিনি বললেন, ‘শোনো, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, চার পায়ে হাঁটা মানুষ যেদিন দুই পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দুনিয়া দেখল সেদিন থেকেই তার চোখ খুলে গেল। আমার কাছেও ব্যাপারটা সেই রকম। আমি যত বাইরে তাকাই, ততই নিজের ভেতরটা দেখতে পাই।’

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম। অধ্যাপক তখন গেয়ে উঠলেন, ‘আপন ঘরে কে কথা কয়, না জেনে আসমানে তাকায়’। পাশের সবচেয়ে উঁচু টিলা রাজার পাহাড় থেকে দোতারার টুংটাং আর লালন সাঁইয়ের এই গান ভেসে আসছিল। বেড়াতে আসা একটা দল এরই মধ্যে সেখানে মজমা জমিয়ে বসেছে। অধ্যাপক মাঝখানে একটু গলা মিলিয়ে বললেন জরথুস্ত্রের উসিলায় ফ্রেডরিক নিৎশের বলা সেই কথাটা, ‘তোমরা পরমানন্দ কামনা করে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকো, আমার তো পরমানন্দ আছে, তাই আমার নজর নিচের দিকে।’

সাংবাদিকের বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের কথা মনে পড়ল আবার। তখন তিনি সুফি ও বাউল দর্শনে বুঁদ। নিজের ভেতরের খবর নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। ঘুরতেন লালনের ‘আপনঘর’, ‘আরশিনগর’ আর ‘বারামখানা’য়। অধ্যাপকের এই দোহারের ভাব দেখে মনে মনে রাগই হলো আমার। কিন্তু সাংবাদিকও স্ত্রীর সঙ্গে গলা মেলালেন। ‘মানুষকে ওপরে থাকতে হয়;’ টিলার ঘাসে চিত হয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে বললেন, ‘কোনো না কোনোভাবে ওপরে থাকতে হয়।’

তাঁদের এই ওপরে থাকার বিষয়টিতে আমার বিরক্তি ধরে গেল। পাহাড়ের চূড়ায় আছেন বলেই হয়তো তাঁরা করুণ-নিমর্ম বাস্তবতাও বিষণ্ণ হাসিতে উপভোগ করতে পারছেন। একই সঙ্গে তাঁরা পাহাড় ও বিষণ্ণতার মধ্যে আছেন, আবার তা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টাও করছেন। তাঁরা ‘যখন নরকের দিকে তাকাচ্ছেন, নরকও তাঁদের দিকে তাকাচ্ছে’। আমার মনে হচ্ছে, সারা জীবন দানবের সঙ্গে লড়াই করতে করতে তাঁরা নিজেরাই কখন যে ধীরে ধীরে কিছুটা হলেও পরমের মতো দানবীয় হয়ে গেছেন, টেরই পাননি। ব্যাপারটা যেন ভূতের আসরের মতো। রাগচাপা হাসি দিয়ে বললাম, ‘আপনাদের দুজনকে জরথুস্ত্র আর নিৎশে মনে হচ্ছে। কিন্তু দুজনই একসঙ্গে ওপরে থাকবেন কীভাবে? সব মানুষই যদি ওপরে থাকতে পারত, তাহলে কথা ছিল না। আপনারা তো দেখছি আনমনে খেলা বিরাট উদাসী শিশু, “নিত্য তুমি হে উদার, সুখে-দুখে অবিকার”।’

নিজের রাগটা আরও পানি করার জন্য বাইনোকুলারের ভেতর দিয়ে তাঁদের দিকে তাকালাম। কৈশোরে আমার প্রিয় খেলা ছিল আতশি কাচ বা বাইনোকুলার দিয়ে খুব কাছ থেকে মানুষের মুখ দেখা। চাঁদের মতো সুন্দর মুখও তখন খানাখন্দে ভরা একটা বিরান প্রান্তরের মতো লাগত। নিজেকে মনে হতো চাঁদের মাটিতে দাঁড়ানো নিল আর্মস্ট্রং।

অধ্যাপকের চেয়ে সাংবাদিককেই আমার বেশি সংবেদনশীল মনে হয়। তিনি আমার মতলবটা ধরে ফেলেছেন, ‘তুমি হয়তো ভাবছ, এই যে আমরা গত কয়েক বছর সরকারের বিরুদ্ধে জান বাজি রেখে লড়লাম, কেন লড়লাম? বড় পদ, বড় অবস্থান, ক্ষমতা এসবের জন্য? নাকি জনগণের কল্যাণ?’ সাংবাদিকের গলা আরও খাদে নেমে গেল, ‘বিরোধীরা তো সরকারের মতোই দুশ্চরিত্রের। তারপরও একচেটিয়া ক্ষমতার চেয়ে গণতান্ত্রিক পালাবদল তো ভালো।’

এরপর তিনি যা বলবেন, আমি তা-ই বলে দিলাম, ‘হুম, ভালো, জনগণকে কিছু দিয়ে আবার ক্ষমতায় আসতে হয়, মাঝখান থেকে জনগণ কিছু অন্তত পায়।’

অধ্যাপক আরও একটু এগিয়ে দিলেন, ‘বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সমর্থকদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যও থাকে।’

সাংবাদিক বললেন, ‘আর আমাদের প্রাপ্তির কথা যে বলছ, শোনো, সব লড়াই কি আমরা জেনেশুনে লড়ি, কখনো তো এমনি এমনিও লড়ি। এই যে পাহাড়ে উঠলাম, এটা আগে থেকে ঠিক করা ছিল না। এই রকম কিছু ব্যাপার তো আছে। আমাদের নিয়ন্ত্রণে ও পরিচালনায় সেগুলোর ক্ষমতা কি, তুমি মনে করো, কম?’

আমি আর নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। হাসতে হাসতে বললাম, ‘কিন্তু ক্ষমতার গণতান্ত্রিক পালাবদলটা তো সুনিয়ন্ত্রিত। শুধু দুই পক্ষের মধ্যে। যা পাওয়ার তা পেতে থাকে সরকারপক্ষ আর বিরোধীপক্ষ, পালাক্রমে, অনন্তকাল; জনগণ তাদের এই পাওয়ার উৎসবে আসা ফকির-ফাকরা, কুত্তা-বিলাই। দান-দক্ষিণার গুড়-বাতাসা আর ঝুটা নিয়েই তাদের খুশি থাকতে হবে।’

আমরা আসলে কেউ কারও গভীর পর্যন্ত যেতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু সাংবাদিক সেদিকেই যাচ্ছেন। অধ্যাপক তা বুঝেই বোধ হয় উঠে পড়লেন। পাহাড়ের খাড়া কিনারায় দাঁড়িয়ে ছটফটে ছোট্ট মেয়ের মতো চেঁচিয়ে জানতে চাইলেন, ‘কতটা উঁচুতে আছি আমরা?’ তাঁর এই হঠাৎ উত্তেজনা দেখে মনে হলো, লাফিয়ে নিচে পড়ার আগে একটা ধারণা নিচ্ছেন। আমি তাঁর দিকে এগিয়ে গেলাম। নিচে তাকিয়ে বললাম, ‘এখানে সবচেয়ে উঁচু টিলার নাম রাজার পাহাড়, ওই যে, যেখানে গান-বাজনা হচ্ছে, ওটা তো দেড় শ ফুট। এটা শ খানেক ফুট হবে হয়তো।’ হুট করেই অধ্যাপক বললেন, ‘আমি নিচে নামছি। তোমরা থাকো।’

তাঁর স্বামী কিংবা আমার কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়ার আগেই তিনি দ্রুত নামতে থাকলেন। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কেন তাঁর নেমে যাওয়ার এমন হঠাৎ তাড়া। যেন তাঁদের সন্তান দুজন নিচে বিপৎসংকুল অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। আসলে তো তা নয়। এই যাত্রায় তো তাঁরা তাদের নিয়েই আসেননি। পরে আবার মনে হলো, হয়তো হঠাৎ টয়লেটে যাওয়ার ব্যাপার থাকতে পারে! আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করব? ওপরে বসে সাংবাদিককে সঙ্গ দেব, নাকি, নিচে নেমে অধ্যাপককে সঙ্গ দেব? ঠিক না করতে পারলেও আমি ঠিকই উঠে দাঁড়ালাম। সাংবাদিক নীরবতা ভাঙার জন্য বললেন, ‘নামছ?’ আমিও বললাম, ‘হুম’। চোখের ওপরে হাত রেখে চিত হয়ে শুয়ে থেকেই তিনি বললেন, ‘যাও, আমি বরং এখানে একটু একা একা চোখ বুজে পড়ে থাকি।’

নিচে নামাটা ওপরে ওঠার মতো কঠিন ছিল না। আমরা পাহাড়ের যে জায়গাটায় আছি, সেখানে লোকজন তেমন নেই। আমাদের মতোই দু-একজন এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করছে। তাদের কাউকে কাউকে দেখা যাচ্ছে মিনিট দশেক পরপর। তাদের চেয়ে বরং বন্য পশুদের আনাগোনা বেশি চোখে পড়ছে। প্রায়ই চোখে পড়ছে শেয়াল। আপনমনে যেতে যেতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে ড্যাবড্যাবে চোখে মানুষ দেখে নিচ্ছে তারাও। কখনো তাড়া খেয়ে ছুটছে বেদিশার মতো। কাঠবেড়ালিগুলো যেন দুষ্টু দুষ্টু বনশিশু। গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে উঁকি মেরেই আবার পালাচ্ছে। আবার বেরিয়ে এসে উঁকি মারছে। ভাবছে, আপনি তার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছেন। কুকুরগুলো ন্যাওটা। আশপাশের লোকালয় থেকে আসা মানুষের মতোই তাদের ফিকির রুটিরুজির। ছোট টিলার ওপরে মেলার মতো জায়গাটায়ই তাদের আনাগোনা বেশি। কখনো ঘন ঝোপের দিকে ছুটছে শেয়াল, শজারু কিংবা বনরুই তাড়া করতে। পাখির কিচিরমিচিরেও তাদের মেজাজ খিঁচড়ে যাচ্ছে মাঝেমধ্যেই। বকে দিচ্ছে ঘেউ ঘেউ করে। শুয়োরের পালের ঘোঁৎ-ঘোঁৎ শব্দ তাদের রাখালের হুম-ম-ম-হুম আওয়াজ ভেসে আসছে দূর থেকে।

এখানে পাহাড়ের চূড়ায় বসে থাকাটা যেমন ঝুঁকির, নিচে নেমে দাঁড়িয়ে থাকাটাও তেমনই ঝুঁকির। বন্য এলাকায় যেসব ঝুঁকি থাকে, জনবিরল হলে, সবই মাথায় রাখতে হয়। নিচে নেমেই আমি অধ্যাপককে খুঁজতে লাগলাম। তিনি একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাকে এগিয়ে যেতে দেখে হাসলেন। স্বামীর কথা জানতে চাইলেন। আমার মনে হলো, আমি তাঁকে ওপরে একা রেখে আসায় তিনি একটু চিন্তায় আছেন। এভাবে নেমে আসায় এখন কিন্তু আমারও খারাপ লাগছে। ফোনটাও ওপরে ফেলে এসেছেন। আমি তাঁকে আমার ফোনটা দিলাম। তিনি তা নিলেন না। তিনি যেন আমার কাছ থেকে তাঁর উদ্বেগ ও আকুলতাটুকু লুকাতে চাইলেন।

অধ্যাপকের হাতে তাঁর বেহালাটা ধরা ছিল। বছর দশেক আগে একবার যখন তাঁদের বাসায় গিয়েছিলাম, তিনি সেদিন আমাদের বেহালা শুনিয়েছিলেন। আচ্ছা, তাঁর কি হঠাৎ বেহালা বাজাতে ইচ্ছা হয়েছিল? নাকি স্বামীকে রাজনীতির বাইরে রাখতেই হুট করে নেমে এলেন? নাকি তিনি নিজেই মুখোমুখি হতে চাননি নিজের? তিনি বেহালায় ছড় বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘বেহালাটা নিচে ফেলে গিয়েছিলাম। ভাগ্যিস, এসে পেয়েছি। ওটা আমার এক জার্মান বন্ধুর দেওয়া উপহার।’

অধ্যাপক বেহালায় একটা সুর তুললেন। পাহাড়ি বনের খুব চেনা সুর। সেটির মাঝে আবার নৌকাবাইচের গানের ধোয়াটা বাজাচ্ছিলেন। হেইয়া রে হেইয়া! হেইয়া হো! এই সুর দুটো তাঁর বেহালায় ঘুরে ঘুরে বাজছিল। একটা আরেকটার মধ্যে মিশে যাচ্ছিল। বন, পাহাড় ও নদীকে সুরে বাঁধতে চাইছিলেন তিনি। এইটুকু আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম। সুরটা আমাকে নিমেষেই আচ্ছন্ন করে ফেলল। আমি একটা পাতা ছিঁড়ে ভাঁজ করে ঠোঁটের ফাঁকে নিয়ে তাঁর সঙ্গে বাজানোর চেষ্টা করছিলাম। সংগীতের সময় গায়ক ও যন্ত্রীর চোখেমুখে যেমন নীরবে স্বতঃস্ফূর্ত ইশারা নাচে, তেমনি আমরাও ভাব বিনিময় করছিলাম।

আমার মনে হলো, আমরা এখন সামনের পাহাড়ি নদীটায় একটা কোষা বা ডিঙি নৌকায় ভাসছি। নৌকায় বসে দুজনে তাল মিলিয়ে বইঠা মারছি। নৌকা চালানোটা যেন আমাদের মুখ্য নয়, আমাদের দুজনের বইঠার তাল ঠিক রাখাটাই আসল। জলের ঘূর্ণি, তীরে ঠেকে যাওয়ার বিপদ, ডুবে যাওয়ার ভয়, ঠিক দিকে নৌকা এগিয়ে নিতে পারা না পারার শঙ্কা—এসবের কোনো কিছুই যেন আমাদের ঘোর ভাঙতে পারছে না। আমরা যেন তাল মেলানোর খেলায় মজে আছি।

অধ্যাপকের স্বামী যেন পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আমাদের এই খেলা দেখছেন আর হাসছেন। জানি যে তিনি তাকিয়ে নেই। তারপরও মনে হলো, ওপরে তাকালেই দেখব তিনি ঈশ্বরের মতো আমাদের পাগলামি দেখছেন। ওপরে তাকালেই যেন আমাদের প্রত্যাশা ভেঙে যেতে পারে, আমাদের বইঠার তাল কেটে যেতে পারে যে কারণে আমি ওপরের দিকে তাকাচ্ছি না।

কোন মন্তব্য নেই:

Popular Posts