রেলওয়ের কারিগরি প্রকল্পে ক্লিনারের বেতন মাসে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। আর অফিস সহায়কের বেতন প্রতি মাসে ৮৩ হাজার ৯৫০ টাকা। যেখানে ক্যাড অপারেটরের বেতন সাধারণত ৫০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা ধরা হয় সেখানে এই প্রকল্পে ধরা হয়েছে সোয়া লাখ টাকা।
আর বিদেশী পরামর্শকদের বেতন মাসে গড়ে ১৬ লাখ টাকা। এসব ব্যয়কে পরিকল্পনা কমিশন অত্যধিক ও গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছে কার্যপত্রে। প্রকল্পে অত্যধিক পরামর্শক রাখা হয়েছে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে। আর অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে দেশে লাগামহীন লুটপাট চলছে। দুর্নীতির বিচার ও শাস্তি না হওয়ায় লুটপাটের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এসব এখনই কঠোর হাতে দমন করতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে পাঠানো রেলওয়ের প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে প্রস্তুতিমূলক কারিগরি সহায়তায় ২৫৬ কোটি ৩১ লাখ টাকা ব্যয়ে কারিগরি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রকল্পে ব্যয়ের বেশির ভাগ অর্থাৎ ১৮০ কোটি ৫০ লাখ ২৯ হাজার টাকা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ঋণ হিসেবে নেয়া হবে। বাকি প্রায় ৭৬ কোটি টাকা হবে সরকারি অর্থায়ন। প্রকল্পের মূল কাজ হলো ১১টি উপপ্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিমূলক কাজ।
অর্থাৎ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, বিস্তারিত ডিজাইন, দরপত্র ডকুমেন্ট প্রস্তুতসহ কিছু আনুষঙ্গিক কাজ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য পরামর্শক থাকবে ১ হাজার ৫৩০ জন। এর মধ্যে বিদেশী পরামর্শক ১ হাজার ১৫৩ জন, স্থানীয় ৩৭৭ জন। ১৩ জন কর্মকর্তা, ১৮ জন জনবল এবং ৯ জন স্টাফ। তবে এই জনবল নিয়োগে কোনো ক্ষেত্রেই অর্থ বিভাগের জনবল কমিটির সুপারিশ কারিগরি প্রকল্প প্রস্তাবনায় (টিপিপি) পাওয়া যায়নি।
পরিকল্পনা কমিশনের কার্যপত্রে দেখা যায়, সহায়তা স্টাফদের জন্য বেতন ধরা হয়েছে আকাশচুম্বী; যা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ক্লিনারের বেতন প্রতি মাসে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা, যা কোনো কোনো প্রকল্পে একজন বিদেশী পরামর্শকের বেতনের সমান বা বেশি। অফিস সহায়কের বেতন ধরা হয়েছে প্রতি মাসে ৮৩ হাজার ৯৫০ টাকা আর ক্যাড অপারেটরের বেতন মাসে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এসব ব্যয় অত্যধিক বলে পরিকল্পনা কমিশন বলছে।
প্রকল্পের ক্রয় পরিকল্পনায় দেখা যায়, পরামর্শক সেবার মূল প্যাকেজটির মূল্য ২৩৮ কোটি ২১ লাখ টাকা। এর আওতায় সব কাজই করা হবে। সেবা ক্রয়ে মাত্র দুটি প্যাকেজ করা হয়েছে। সম্ভবত একটি ফার্মের মাধ্যমে এই কাজ করা হবে। প্রকল্পভুক্ত ১১টি উপপ্রকল্পের কাজ একক প্যাকেজের পরিবর্তে ৪ থেকে ৫টি প্যাকেজের মাধ্যমে করা উচিত বলে ভৌত অবকাঠামো বিভাগ থেকে বলা হয়েছে। প্রকল্পে ১৩ জন কর্মকর্তা প্রেষণে অতিরিক্ত দায়িত্বে কাজ করবেন। আরো ৫ জনকে নিয়োগ দেয়া হবে। এ ছাড়া ৯ জন স্টাফ আউটসোর্সিং হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই জনবল কমিটির সুপারিশ টিপিপিতে সংযুক্ত করা হয়নি। প্রকল্পটি চলতি বছরের জুলাই থেকে আগামী ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদন চাওয়া হয়েছে।
ব্যয় বিভাজন পর্যালোচনা করে পরিকল্পনা কমিশন বলছে, প্রকল্পে সব মিলে ১ হাজার ৫৩০ জন পরামর্শক রাখা হয়েছে। প্রকল্পে পরামর্শকের আধিক্য রয়েছে। আবার একই বিষয়ে দুই বা ততোধিক পরামর্শকের সংস্থান রাখা হয়েছে, যা অর্থের অপচয়। আন্তর্জাতিক পরামর্শকের বেতন প্রতি মাসে ২৫ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। এই খাতে ব্যয় প্রতি মাসে গড়ে ১৬ লাখ টাকা। সম্প্রতি অনুমোদিত এডিবির সমজাতীয় প্রকল্পের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এই ব্যয় যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে। এসব আলোচনা করে কমিয়ে আনা প্রয়োজন। আবার পরামর্শক ব্যয়ের সাথে গাড়ি ভাড়া বাবদ ৪ কোটি ১৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। এই ব্যয়ের কোনো যৌক্তিকতা নেই বলেও ভৌত অবকাঠামো বিভাগ মন্তব্য করেছে।
যে ১১টি উপপ্রকল্পের জন্য এই কারিগরি প্রকল্প তার মধ্যে হলো- হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর বিদ্যমান রেলসেতুর সমান্তরালে নতুন একটি সেতু নির্মাণের জন্য বিশদ নকশাসহ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, আব্দুলপুর-রাজশাহী সেকশনে আরেকটি সমান্তরাল ব্রডগেজ লাইনের জন্য বিশদ ডিজাইনসহ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, সান্তাহার থেকে রোহনপুর নতুন ব্রডগেজ লাইনের জন্য বিশদ ডিজাইনসহ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, সান্তাহার-বগুড়া-কাউনিয়া-লালমনিরহাট সেকশনে বিদ্যমান মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজ লাইনের জন্য বিশদ ডিজাইনসহ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত কর্ড লাইনের সমান্তরাল নতুন ব্রডগেজ লাইনের জন্য বিশদ ডিজাইনসহ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, যশোর থেকে বেনাপোল সমান্তরাল নতুন ব্রডগেজ লাইনের জন্য বিশদ ডিজাইনসহ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ইত্যাদি।
এই খরচের ব্যাপারে ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য শামীমা নার্গিসের সাথে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে মোবাইলে যোগাযোগ করে তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে রেল উইংয়ের যুগ্ম-প্রধান মো: মতিউর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি একটা মিটিংয়ে আছেন বলে জানান।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদের মতে, চোখ বন্ধ করে দুর্নীতি করা হচ্ছে। যেখানে প্রধানমন্ত্রী বলছেন দুর্নীতিতে জিরো টরালেন্স সেখানে তারা কিভাবে এবং কারা এভাবে দুর্নীতি করার সাহস পাচ্ছে। ক্লিনারের বেতন ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা কোনো মতেই হতে পারে না। এসব হলো চরম মাত্রায় দুর্নীতি। তিনি বলেন, এক সময় আমরা দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। সেখান থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। বিদেশ থেকে ঋণ এনে সেই টাকা এভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে অপব্যবহার করা হলে বিদেশীরা আমাদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা করবে।
তিনি বলেন, যেখানে খুব দ্রুত আমরা উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার আশা করছি সেখানে এসব দুর্নীতি আমাদেরকে সেই প্রত্যাশা পূরণে বাধাগ্রস্ত করবে এবং করছে। এসব দুর্নীতি না থাকলে আমরা আরো আগেই মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে পারতাম। এই যে বালিশ দুর্নীতি, ৩৭ লাখ টাকায় পর্দার কাপড় কেনা এগুলো আমাদের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করছে।
ক্লিনারের বেতন সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এসবের ব্যাপারে কঠোরতম ব্যবস্থা নিতে হবে। যেটা না করার কারণে দুর্নীতির মাত্রা বেড়েই চলেছে। একজন ক্লিনারের বেতন মাসে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা এটা লুটপাট ছাড়া কিছুই না। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে এসব কী হচ্ছে? তিনি বলেন, সরকারের বিভিন্ন খাতে যে দুর্নীতি ও অর্থের অপব্যবহার হচ্ছে তার কোনো বিচার ও শাস্তি হচ্ছে না। যার কারণে এসব কর্মকাণ্ড এখন লাগামহীনভাবে চলছে। এভাবে দেশ চলতে পারে না। জনগণের করের টাকা এবং জনগণের মাথায় ঋণের দায় চাপিয়ে দিয়ে বিদেশ থেকে ঋণ এনে তা এইভাবে লুটপাট ও তছরুপ করা হচ্ছে। এগুলোকে কঠোরভাবে দমন করা দরকার। যারা এসব করছে তাদের ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে এখনই।
© Nayadiganta
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন