Recent post

মঙ্গলবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২২

স্বাস্থ্যের জরুরি কেনাকাটায় ১৯৩ কোটি টাকার অনিয়ম



করোনা মহামারির শুরুতে জরুরি সুরক্ষাসামগ্রীসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন কেনাকাটায় ১৯৩ কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এই অনিয়ম উঠে এসেছে। এ–সংক্রান্ত নিরীক্ষা আপত্তি নিয়ে গতকাল রোববার সরকারি হিসাবসংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়। কমিটি কেএন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে তদন্ত এবং অযোগ্য ও অনভিজ্ঞ সরবরাহকারীর সঙ্গে চুক্তি করে সুরক্ষাসামগ্রী কেনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছে।




সংসদীয় কমিটি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে জরুরি ভিত্তিতে ১ হাজার ১১২ কোটি টাকার (কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস প্রজেক্ট) প্রকল্প গ্রহণ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের প্রথম অর্থবছরের যেসব নিরীক্ষা আপত্তি এসেছে, তার মধ্যে ১২টি নিষ্পত্তি হয়নি।


নিরীক্ষায় একটি আপত্তিতে বলা হয়, ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই), মাস্ক ও হ্যান্ডগ্লাভস সরবরাহের জন্য মেসার্স জাদিদ অটোমোবাইলস জেএআইয়ের সঙ্গে ২০২০ সালের ১৯ মে ৩১ কোটি ৯০ লাখ টাকার চুক্তি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটি দেড় লাখ কেএন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ করার কথা। এর মধ্যে সরকারের কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) ২৪ হাজার মাস্ক ভেজা অবস্থায় গ্রহণ করেছে। প্রতিটি মাস্ক ৫২০ টাকা হিসাবে এখানে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ২৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
এই আপত্তির জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, সিএমএসডিতে মাস্কগুলো নেওয়ার সময় কোনো মাস্ক ব্যবহার অযোগ্য হিসেবে দেখানো হয়নি। পরবর্তী সময়ে পরীক্ষা করে মাস্কের গুণাগুণ সম্পর্কে সন্তোষজনক ফল পাওয়া গেছে। তবে তাদের এই বক্তব্য গ্রহণ করেনি নিরীক্ষা অধিদপ্তর। প্রতিবেদনে বলা হয়, জবাবের সঙ্গে সংযুক্ত প্রামাণিক চালানের কপিতে ‘সিএমএসডি কর্তৃক রিসিভসংক্রান্ত মন্তব্য অংশ’ ঘষামাজা করে মুছে ফেলা হয়েছে। পরীক্ষা প্রতিবেদনের সংযুক্তিও পাওয়া যায়নি।

আরেকটি আপত্তিতে বলা হয়, চুক্তির চেয়ে দুই হাজার কম মাস্ক সরবরাহ করেছে। প্রতিটি মাস্কের দাম ৫২০ টাকা হিসাবে ক্ষতি হয়েছে ১০ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এর জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, জাদিদ অটোমোবাইলস চুক্তি অনুযায়ী দেড় লাখ মাস্ক সরবরাহ করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিরীক্ষা অধিদপ্তর বলেছে, চালানের কপিতে সিএমএসডি কর্তৃক প্রাপ্তিস্বীকারসংক্রান্ত মন্তব্য অংশ ঘষামাজা করে মুছে ফেলা হয়েছে। পুরোনো চালান ঘষামাজা করে মালামাল গ্রহণের প্রমাণক দেওয়া হয়েছে।

এই প্রকল্পের তিনটি প্যাকেজে দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ২ লাখ পিপিই ও ৩ লাখ ১০ হাজার মাস্ক এবং ১ হাজার ৫৫০ থার্মোমিটার কেনা হয়। কিন্তু বিতরণের নথিতে দেখা যায়, ১ লাখ ৮৪ হাজার পিপিই, প্রায় ৩ লাখ মাস্ক এবং ৬৫০টি থার্মোমিটার বিতরণের কোনো প্রাপ্তিস্বীকারপত্র নেই। এতে মোট ৩২ কোটি ৮৫ লাখ টাকার গরমিল রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দাবি, দেশব্যাপী কুরিয়ারের মাধ্যমে এসব পাঠানো হয়। তবে নিরীক্ষা অধিদপ্তর বলেছে, প্রমাণ হিসেবে কুরিয়ার সার্ভিসের যে চালান দেওয়া হয়েছে, তাতে মালামাল গ্রহণ ও বিতরণের বিষয় যথাযথভাবে সন্নিবেশিত ও কর্তৃপক্ষের সই নেই।




পৃথক আপত্তিতে বলা হয়, অযোগ্য ও অনভিজ্ঞ সরবরাহকারীর কাছ থেকে ৫৯ কোটি ৪০ লাখ টাকার সুরক্ষাসামগ্রী কেনা হয়েছে। যারা গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশ এবং কম্বল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া ৪৭ কোটি টাকার সামগ্রী অব্যবহৃত ফেলে রাখা হয়। একই প্রকৃতির চিকিৎসাসামগ্রী একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন দরে কেনায় ক্ষতি হয় ১৭ কোটি টাকা। সরকারি ক্রয়নীতি লঙ্ঘন করে প্রায় ১১ কোটি টাকার কাজ জামানত ছাড়াই চুক্তি করা হয়। ৬ কোটি টাকার বেশি অনিয়মিত ব্যয় হয় মোবাইল অ্যাপ, টিভিক্লিফ, সফটওয়্যার তৈরির কাজে। সরবরাহকারী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মালামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ায় চুক্তি মোতাবেক বিলম্ব জরিমানা ছাড়াই বিল পরিশোধ করায় ৪ কোটি টাকার বেশি সরকারের ক্ষতি হয়েছে। প্রকল্প প্রস্তাবে উল্লেখ করা দরের চেয়ে বেশি দামে চিকিৎসাসামগ্রী কেনায় সরকারের পৌনে ৮ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
এই বিষয়ে সরকারি হিসাবসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি রুস্তম আলী ফরাজীর বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে গতকাল বৈঠক শেষে সংসদ সচিবালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ব্যবহার অনুপযোগী ও পরিমাণে কম মাস্ক সরবরাহের বিষয়টি দুদকের মাধ্যমে তদন্ত এবং অযোগ্য সরবরাহকারীর সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে তদন্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে কমিটি করার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি।


ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে গণমাধ্যম এবং বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছিল, সিএজির প্রতিবেদন সেটাই প্রমাণ করছে। নিরীক্ষা আপত্তির অর্থ এই নয় যে অনিয়ম হয়ে গেছে। তবে অধিদপ্তরের ব্যাখ্যা যদি সন্তোষজনক না হয়, তাহলে অবশ্যই এই বিষয়গুলো নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।


কোন মন্তব্য নেই:

Popular Posts