ভায়াগ্রার ইতিহাস: একটি দুর্ঘটনা থেকে বিপ্লব
ভায়াগ্রা (Viagra) — নামটি শুনলেই মানুষের মনে এক ধরনের কৌতূহল জন্ম নেয়। এটি এমন একটি ওষুধ, যা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ পুরুষের জীবনে এক বিপ্লব এনেছে। অথচ এর আবিষ্কার ছিল একেবারেই দুর্ঘটনাবশত, সম্পূর্ণ অন্য একটি উদ্দেশ্যে শুরু হওয়া চিকিৎসা গবেষণার ফলাফল।
শুরুটা ছিল হৃদরোগের চিকিৎসা দিয়ে
১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে, বিখ্যাত আমেরিকান ওষুধ কোম্পানি ফাইজার (Pfizer) ব্রিটেনের সাউথ ওয়েলস অঞ্চলে একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করে। গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি ওষুধ তৈরি করা, যা উচ্চ রক্তচাপ এবং এনজিনা (Angina) বা বুকের ব্যথা দূর করতে পারে।
এই গবেষণায় তারা একটি রাসায়নিক উপাদান সিলডেনাফিল সাইট্রেট (Sildenafil Citrate) ব্যবহার করছিল, যার কোডনেম ছিল UK-92,480।
পরীক্ষার সময় অপ্রত্যাশিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
স্বেচ্ছাসেবকদের এই ওষুধ দেওয়া হচ্ছিল দিনে তিনবার। কিন্তু কিছুদিন পর গবেষকরা লক্ষ্য করেন, স্বেচ্ছাসেবকদের অনেকে লজ্জা-লজ্জা মুখে জানাচ্ছেন— তাঁদের লিঙ্গে অস্বাভাবিকভাবে দৃঢ়তা তৈরি হচ্ছে।
গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া ডাক্তার ও নার্সরা প্রথমে বিষয়টিকে পাত্তা না দিলেও পরবর্তী পর্যবেক্ষণে বুঝতে পারেন, এটি সিলডেনাফিল-এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নয় বরং একটি শক্তিশালী সম্ভাবনা।
‘গেম চেঞ্জার’ ওষুধ
ফাইজার তখন বুঝতে পারে, এই ওষুধ হয়তো ইরেক্টাইল ডিসফাংশনের (Erectile Dysfunction বা ED) চিকিৎসায় ব্যবহার করা যেতে পারে। শুরু হয় নতুন গবেষণা, নতুন টার্গেট গ্রুপে ট্রায়াল — যেখানে শতভাগ সফলতা আসে।
পরীক্ষার সময় অনেক স্বেচ্ছাসেবক অব্যবহৃত ওষুধ ফেরত দিতেই অস্বীকৃতি জানান! কারণ ওষুধের কার্যকারিতা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে সবাই এটি রেখে দিতে চেয়েছিল।
বাজারে যাত্রা শুরু
১৯৯৮ সালে মাত্র ছয় মাসের মধ্যে মার্কিন FDA এই ওষুধের অনুমোদন দেয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের বাজারে "ব্লু পিল" নামে ভায়াগ্রা ছাড়া হয়।
শুরুতেই এই ওষুধ বাণিজ্যিক দিক থেকে বিপুল সফলতা লাভ করে। শুধুমাত্র প্রথম তিন মাসে আমেরিকানরা ভায়াগ্রার পিছনে খরচ করে প্রায় ৪০ কোটি ডলার।
সমাজে প্রভাব: বিব্রততা থেকে মুক্তি
ভায়াগ্রার আবিষ্কার অনেক পুরুষকে হতাশা, আত্মসম্মানহীনতা ও দাম্পত্য টানাপোড়েন থেকে মুক্তি দিয়েছে। এটি শুধু যৌন ক্ষমতা ফেরায়নি, বরং অনেক সম্পর্ক ও পরিবারকে রক্ষা করেছে।
এমনকি খ্রিস্টানদের আধ্যাত্মিক নেতা পোপ-ও ভায়াগ্রাকে সমর্থন করেন। তাঁর মতে, এটি বৈধ দাম্পত্য সম্পর্ক রক্ষা করতে সহায়ক হতে পারে।
বিজ্ঞাপন ও পোস্টার বয়
বিশ্বখ্যাত ব্রাজিলিয়ান ফুটবল কিংবদন্তি পেলে হয়ে ওঠেন ভায়াগ্রার প্রথম "পোস্টার বয়"। এই পদক্ষেপ ভায়াগ্রার বাজারকে আরও বড় করতে সাহায্য করে এবং সচেতনতা বাড়ায়।
ভায়াগ্রা কিভাবে কাজ করে?
ভায়াগ্রা মূলত পুরুষের লিঙ্গে রক্তপ্রবাহ বাড়িয়ে তাকে দৃঢ় করে। এটি মস্তিষ্কে নাইট্রিক অক্সাইড নিঃসরণ ঘটায়, যা ধমনিকে প্রশস্ত করে এবং যৌন উদ্দীপনার সময় লিঙ্গে রক্ত আটকে রাখতে সাহায্য করে। এর ফলে লিঙ্গ দীর্ঘক্ষণ দৃঢ় থাকে এবং ইরেকশন বজায় থাকে।
অর্থনৈতিক সাফল্য
২০০৮ সালের মধ্যে ভায়াগ্রার বিক্রি গিয়ে দাঁড়ায় বছরে প্রায় দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটি ইতিহাসের অন্যতম দ্রুত বিক্রিত এবং লাভজনক ওষুধে পরিণত হয়।
শেষ কথা
ভায়াগ্রার আবিষ্কার ছিল নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এটি শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে নয়, মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এবং সামাজিক মূল্যবোধেও এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
এটি প্রমাণ করে, বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রতিটি ধাপ—even ব্যর্থতাও—একটি নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিতে পারে।
0 মন্তব্যসমূহ