সতেরো বছর পর সৌদি আরব থেকে পাকাপাকিভাবে বাংলাদেশে ফিরে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন দেখতে পান, স্বজনদের কাছে এতো বছর ধরে তিনি যে টাকাপয়সা পাঠিয়েছিলেন, তা বেহাত হয়ে গেছে।
দেশে ফিরে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার মতো টাকাপয়সাও তখন তার হাতে নেই। অবশেষে তাকে ঠাই নিতে হয়েছে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সেফ হোমে। তার পরিস্থিতির একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক মাধ্যমেও।
প্রবাসী বাংলাদেশীদের জীবনে এমন ঘটনা একেবারে বিরল কিছু নয়।
বাংলাদেশে বিদেশ থেকে আসা অর্থের বড় অংশটি আসে রেমিট্যান্স খাতে, অর্থাৎ প্রবাসী আয়ের মাধ্যমে - যারআবার একটি বড় পরিমান পাঠান বিদেশে কাজ করা অদক্ষ কর্মীরা। পুরো বছরে প্রবাসীরা ২ হাজার ১৭৪ কোটি মার্কিন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ কমবেশি ১ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
কিন্তু যে প্রবাসীরা কঠোর পরিশ্রম করে অর্জিত অর্থ দেশে পাঠান, তাদের অনেকেই দেশে ফিরে স্বজনদের দ্বারা প্রতারণার শিকার হন। ওই অর্থ যাদের কাছে পাঠানো হয়, তারা নানা কারণে টাকা খরচ করে ফেলেন, আবার অনেক প্রবাসীর পাঠানো অর্থে গড়া সম্পদ শেষ পর্যন্ত অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরীফুল হাসান জানান যে প্রতি বছর ঠিক কত সংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক দেশে পাঠানো টাকা নিয়ে প্রতারণার শিকার হন, তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান তাদের কাছে নেই।
"তবে আমরা যারা প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করি, বিশেষ করে বিমানবন্দরে একটি জরুরি সেবা দেই, আমরা দেখেছি যে প্রায়ই এই ধরণের ঘটনা ঘটে।
যে মানুষদের জন্য তারা বিদেশে থেকে কষ্ট করে টাকা পাঠাচ্ছেন, তারা সেগুলো খরচ করে ফেলছে, তাদের গ্রহণ করতে চায় না,'' বিবিসি বাংলাকে জানাচ্ছিলেন তিনি।
শরীফুল হাসান আরও বলেন, ''আমাদের পর্যবেক্ষণে দেখেছি, পুরুষদের চেয়ে নারীদের ক্ষেত্রে এটা বেশি হয়।
যে নারী এতো কষ্ট করে আয় পাঠাচ্ছেন, তার স্বামী হয়তো আরেকটা বিয়ে করে ফেলছে, অথবা সেই আয় তার নিজের নামেই নেই।"
অন্যদিকে প্রবাসী পুরুষদের বিষয়ে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে এমনটা দেখা যায় যে একজন প্রবাসী কর্মীর স্ত্রী হয়তো টাকা খরচ করে ফেলেছেন, অথবা তার বাবা-ভাই সম্পত্তি নিজেদের নামে নিবন্ধন করেছে।
প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা আরেকটি প্রতিষ্ঠান রামরুর চেয়ারপারসন তাসনীম সিদ্দিকী জানান, এমন অনেক হয়েছে যে প্রবাসীর টাকায় হয়তো পরিবারের সম্পত্তি হয়েছে, কিন্তু প্রবাসীকে দেশে ফিরে এসে তা বাবা-ভাই-বোনদের সাথে ভাগ করে নিতে হচ্ছে।
অথবা এমনও হয়েছে যে কেউ হয়তো ভাইয়ের কাছে কাছে টাকা পাঠিয়েছেন, কিন্তু ভাই নিজের নামে সম্পত্তি করেছেন। অথবা স্ত্রীর নামে অর্থ পাঠিয়েছেন, তিনি হয়তো ভাই বা অন্য কারো সঙ্গে ব্যবসা করতে গিয়ে হারিয়েছেন - বলছিলেন অধ্যাপক সিদ্দিকী।
তিনি জানান, ব্যাংকে সঙ্গে তারা একটি প্রশিক্ষণ করতে গিয়ে বেশ কিছু পরামর্শ পেয়েছেন এবং এখন সেগুলোই তারা প্রবাসীদেরকে অনুসরণ করার পরামর্শ দেন।
প্রশ্ন হলো, তাহলে কীভাবে নিজেদের অর্থ সঞ্চয় করতে পারেন প্রবাসীরা?
রামরু এবং ব্র্যাকের অভিবাসন বিষয়ক কর্মকর্তারা প্রবাসীদের এই ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি পরামর্শ দিচ্ছেন -
অন্তত দুইটি হিসাব খুলে বিদেশে যাওয়া
তাসনীম সিদ্দিকী বলেন যে তারা এখন একটি ক্যাম্পেইন চালাচ্ছেন যেখানে বলা হচ্ছে যে প্রত্যেক প্রবাসীর উচিত বিদেশে যাওয়ার আগে দুইটি ব্যাংক হিসাব খুলে যাওয়া। তার একটিতে তিনি পরিবারের ভরণপোষণের জন্য অর্থ পাঠাবেন, আরেকটিতে থাকবে তার নিজের জমানো টাকা।
তাদের পরামর্শ হলো, এজন্য তারা ব্যাংকে নানা মেয়াদী সঞ্চয়ী স্কিম খুলে যেতে পারেন, যেখানে তাদের হিসাব থেকে সরাসরি টাকা জমা হবে।
বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমনটা অনেক সময় দেখা যায় যে অনেক প্রবাসী কর্মী দেশে থাকা পিতা-মাতার নামে টাকা পাঠান। অনেক ক্ষেত্রে আবার অনেক সময় স্ত্রীর কাছ থেকে অভিযোগ আসে যে তাকে ঠিকভাবে খরচ দেয়া হচ্ছে না।
''এসব ক্ষেত্রে স্ত্রী ও পিতা বা পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে আলাদা আলাদা হিসাব খুলে সেখানে টাকা পাঠানো যেতে পারে। তাহলে যেমন কোন জটিলতা থাকবে না, আবার নিজের টাকার ওপরেও তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে,'' বলেন তাসনীম সিদ্দিকী।
শুরু থেকেই সঞ্চয়ের পরিকল্পনা
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, অর্থ উপার্জনের জন্য বা চাকরি নিয়ে যখন কেউ বিদেশে যাচ্ছেন, তখন থেকেই তাকে পরিকল্পনা করতে হবে যে উপার্জিত অর্থ তিনি কীভাবে কাজে লাগাবেন।
অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, ''আপনি যখন বিদেশে যাচ্ছেন, যে টাকা পয়সা উপার্জন করছেন, আপনি ভাববেন না যে সেটা শুধুমাত্র আপনার পরিবারের বর্তমান খাওয়া-পরার অর্থ।
''আপনি যখন দেশে ফিরে আসবেন, তখন আপনার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেও টাকা প্রয়োজন। শুরু থেকেই আপনাকে সঞ্চয়ের ব্যাপারটি ঠিক করতে হবে - কীভাবে বিনিয়োগ করবেন, কোথায় বিনিয়োগ করবেন, তা ভাবতে হবে।''
পারিবারিক বিনিয়োগ শুরু করতে পারেন
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরীফুল হাসান বলছেন, প্রবাসীদের নিজেদের নামে বাংলাদেশে সরাসরি বিনিয়োগের সুযোগ খানিকটা সীমিত। দেখা গেছে, প্রবাসীরা বরং জমি, বাড়ি ইত্যাদির পেছনে বেশি বিনিয়োগ করেন।
"এমন কি তাদের জন্য সঞ্চয়ের স্কিমও বেশি নেই।"
তিনি পরামর্শ দেন যে প্রবাসীরা তাদের পারিবারিক স্বজন বা স্ত্রীর মাধ্যমে বাড়ি-কেন্দ্রীক খামার বা ছোটখাটো ব্যবসা করতে পারেন। যেমন মুরগির খামার, মাছের চাষ ইত্যাদি ছোটখাটো ব্যবসাও করতে পারেন।
শরীফুল হাসান বলেন, ''বিদেশে অনেক বড় বড় বিনিয়োগকারী রয়েছেন, যারা দেশেও বড় আকারে বিনিয়োগ করতে চান। তাদের জন্য সরকারিভাবে বিশেষ পরিকল্পনা নিতে হবে - অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা যেতে পারে - যাতে তারা দেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হন।''
জমি বা বাড়ির নিবন্ধনে নিজের নাম নিশ্চিত করা
অনেক সময় বিদেশ থেকে পাঠানো অর্থে প্রবাসীর ঘনিষ্ঠ স্বজনেরা নিজেদের নামে জমি বা বাড়ি রেজিস্ট্রি করে থাকেন। পরবর্তীতে প্রবাসীরা দেশে ফিরে মালিকানা জটিলতায় পড়েন।
এক্ষেত্রে অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন যে জমি বা বাড়ির পুরো টাকা পরিশোধের আগে অবশ্যই সেটি তার নিজের নামে হচ্ছে কি-না, সেটা নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে।
সবচেয়ে ভালো হয় যদি তিনি বাংলাদেশে থাকার সময়ই এ ধরণের সম্পত্তির হস্তান্তর নিশ্চিত করা যায়।
দেশে পাঠানো টাকার খরচের হিসাব রাখুন
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে যে টাকা-পয়সা পাঠানো হয়, অভিবাসীদের উচিত সেই টাকা কোথায়, কীভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে, কীভাবে খরচ করা হচ্ছে, সে বিষয়ে নিয়মিতভাবে খবর রাখা।
প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেসব কাগজপত্রের ছবি দেখা এবং অনলাইনে যাচাই করে দেখা।
ফলে একজন স্বজন চাইলেও প্রবাসী অর্থ আয়কারীকে কোনরকম প্রতারণা করতে পারবে না বা ঠকাতে পারবে না।