শহরের এই পাশটা এখনো গ্রামের মতো সুনসান।
খুব একটা বাড়িঘর ওঠেনি। মূল সড়ক থেকে একটু ভেতরের দিকে গেলে চোখে পড়বে দু-একটা পাকা দালান।
শেষ হয়নি সেগুলোর নির্মাণকাজও। কঙ্কালসদৃশ এসব ভবনের চারপাশ থেকে হাড়গোড়ের মতো বেরিয়ে আছে কোথাও লম্বা, আবার কোথাও ছোট-বড়, মোটা-চিকন রড।
গায়ে সিমেন্টের পলেস্তারা পড়েনি ঠিকমতো। শুধু কাঠামোটা দাঁড়িয়ে আছে।
এই নগ্ন নির্জন বাড়িগুলোর আশপাশের কয়েকটা প্লটে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো চোখে পড়বে বালুর স্তূপ। কোথাও সারি সারি করে রাখা আছে ইট। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সেগুলোর গায়েও সবুজ শেওলা পড়ে গেছে। আরও আছে লম্বা লম্বা ঘাস।
এসবের ভেতর দিয়ে চলে গেছে মাটির সরু রাস্তা। তার গায়ে বড় বড় গর্ত। গর্তের ভেতরে বৃষ্টির পানি জমে একেকটা ছোটখাটো পুকুর।
রাস্তার দুপাশে কখনো কখনো ঘন কাশবন। এর ভেতর দিয়েই দিনের বেলায় দু-একটা ট্রাককে খ্যাপা ষাঁড়ের মতো চারপাশের সবকিছু দুমড়ে-মুচড়ে ছুটে যেতে দেখা যায়।
অনেক দিন পর এই এলাকায় ঘুরতে এসেছেন মইন আলী। শুক্রবার হলে সপরিবার কোথাও না কোথাও বেড়াতে যান তিনি। দূরে কোথাও না গেলেও অন্তত বাড়ির কাছেই কোনো একটা রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয় তাদের। মইনই আজ প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন তার স্ত্রীকে: ‘চলো, আজ শহরের বাইরে কোথাও থেকে ঘুরে আসি।’
‘বাইরে কোথায়? বেশি দূরে?’
‘না না, বেশি দূর না, এই তো এয়ারপোর্টটা পার হলেই হাতের বাঁয়ে পড়বে। এলাকাটার কথা অনেক শুনেছি। কিন্তু কখনো যাওয়া হয়নি, ‘ওয়ার্ডরোব থেকে নতুন একটা শার্ট বের করে তার ভাঁজ খুলতে খুলতে মইন বললেন, ‘গিয়েছিলাম একবার। কিন্তু অনেক আগে। রাতের বেলায় বলে ঠিকমতো কিছু দেখতেও পাইনি।’
‘ওখানে হঠাৎ?’
‘শুনেছি এখনো কিছু জমি বিক্রি হচ্ছে। দামেও নাকি সস্তা। তোমাকে তো আর গুলশান-বনানীতে বাড়ি বানিয়ে দিতে পারব না। তাই ওখানে একটু চেষ্টা করে দেখি।’
ফওজিয়া আর কথা বাড়াননি। খুব দ্রুত সুতির একটা শাড়ি জড়ালেন শরীরে।
লাল পাড়ের অফ হোয়াইট। ঠোঁটে না লাল না গোলাপি লিপস্টিক দিলেন। কপালে কমলা রঙের বড় একটা গোল টিপ। হাত দুটো ভর্তি করলেন সাতরঙা কিছু চুড়িতে। তারপর হাতব্যাগটা বগলের নিচে চালান করে দিয়ে, নিচে নামার জন্য দুজন ঢুকে গেলেন লিফটের ভেতরে। ফওজিয়া খেয়াল করলেন, তার স্বামীর গা থেকে খুব সুন্দর একটা গন্ধ আসছে। এই পারফিউমটা আবার কবে কেনা হলো, মনে মনে ভাবলেন ফওজিয়া। কিন্তু এ নিয়ে কিছু বললেন না। বরং মাথাটা উঁচু করে, মইনের মুখের দিকে তাকিয়ে, খুব মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘ইউ আর সো হ্যান্ডসাম মাই ম্যান।’
ডিসেম্বরের বিকেলের বাতাসে, ব্যস্ত শহরে কচ্ছপগতির যানবাহনের ফাঁকফোকরের ভেতর দিয়ে, গাড়ি চালাতে চালাতে মইন আলী ভাবছিলেন, যা কিছু করার এখনই করতে হবে। তিনি এখন যে পজিশনে আছেন, তার নিজের জন্য কিছু করার এটাই সবচেয়ে মোক্ষম সময়। এখন দলের সিটি কমিটির নেতা। গত বছর সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছেন। তার কানেকশনও ভালো। দলের ওপরের মহলে এবং সরকারের ভেতরে তার অবাধ যাতায়াত। বন্ধুরাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন বাহিনীতে। তার ক্ষমতার হাতও এতখানি দীর্ঘ যে কেউ কিছু চাইলে সেটা তিনি মোটামুটি করে দিতে পারেন। সে কারণে তার নিজের চাওয়া-পাওয়ারও একটা দাম আছে অন্যদের কাছে। পরে কী হয় কে জানে, তাই এখন ঘুমিয়ে থাকলে চলবে না। তিনি জানেন, ঘুমন্ত শৃগাল কখনো শিকার ধরতে পারে না।
তারা চলে এসেছেন বেশ দূরে। শহরের বাইরে হলেও এই এলাকায় সম্প্রতি কতগুলো দেশি রেস্তোরাঁ খুলেছে। দেখতে আহামরি কিছু নয়, খুব সাধারণ। লোকে বলে বাংলা হোটেল। বাঁশ দিয়ে তৈরি। চারপাশটা খোলা। কোনো দেয়াল নেই। রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে মাথার ওপরে শুধু টিনের ছাদ। ভেতরে কাঠের টেবিল পাতা। সারি সারি। অতিথিরা বসেন বেঞ্চিতে। টেবিলের চারপাশ দিয়ে আড়াআড়ি করে রাখা লম্বা লম্বা টুল। বাঁশের।
মইন তার কয়েকজন সহকর্মীর কাছে শুনেছেন, দেখতে ভাঙাচোরা হলেও এসব রেস্তোরাঁর খাবার খুবই সুস্বাদু। কারণ, এখানে লাকড়ি দিয়ে রান্না হয় মাটির চুলায়। প্রায় সব ধরনের ভর্তা, ভাজি, মাছ ও সবজির তরকারি পাওয়া যায়। তরতাজা আর ফরমালিনের অভিশাপ থেকে মুক্ত এসব খাবার।
মইন আলীর ইচ্ছে আজ এখানেই ডিনার শেষে বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু কথাটা এখনো বলা হয়নি ফওজিয়াকে। গাড়িটা রাস্তার এক পাশে, হাইওয়ে থেকে যেখানে একটা কাঁচা রাস্তা একটু নিচু হয়ে হঠাৎ করে জমির দিকে কাত হয়ে নেমে গেছে, সেখানে পার্ক করে তারা দুজনে একটু হাঁটাহাঁটি করলেন। এ রকম খোলা জায়গায় বহুদিন আসেননি ফওজিয়া। মৃদুমন্দ বাতাসে তার শাড়ির আঁচল উড়তে লাগল। সেই সঙ্গে কিছুটা চঞ্চল হলো তার চিত্তও। প্রকৃতির কারণে তার মনের ভেতরে যে এ রকম একটা শিহরণ তৈরি হতে পারে, সেটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি।
সোজা হাঁটতে হাঁটতে আরও পশ্চিম দিকে চলে গেলেন তারা। দেখলেন, ভেতরের দিকে শুধু প্লটের পর প্লট। কোথাও সীমানা দেওয়া, কোথাও সীমানা ছাড়া। কোথাও কোমরসমান ইটের দেয়াল, আবার কোথাও সীমানা থাকলেও সেটা চাপা পড়ে গেছে লম্বা লম্বা ঘাসের আড়ালে। লাল সুরকির রাস্তা ধরেই এগোতে লাগলেন ওঁরা। দুপাশে কোথাও পড়ল ছোট ডোবা, তার মধ্যে টলটল করছে পরিষ্কার পানি, কোথাও কোনো এক প্লটের গর্বিত মালিক বালুর মধ্যেই শখ করে লাগিয়েছে পেয়ারাগাছ। পাতাগুলো হলুদ হয়ে মরে যাচ্ছে।
দূরের একটা পাইলনকে টার্গেট করে এগিয়ে গেলেন দুজন। কিছুক্ষণ পর সাইকেল নিয়ে ছুটে এল রুগ্ণ এক তরুণ। সে ভেবেছিল, ওরাও হয়তো কোনো একটা প্লটের মালিক। জানতে চাইল, ওরা জমিতে বালু ফেলবেন কি না। মইন তখন তার কাছে কিছু খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করলেন। বিক্রির জন্য কোথায় কোথায় এখনো জমি আছে, কতটুকু জমি, ঝামেলামুক্ত কি না, মালিক কোথায় থাকেন, আরও জানতে চাইলেন ওসব জমি এখন কত করে বিঘা।
হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় এসে থামলেন তারা। অবশ্য সামনে এগোনোর আর কোনো সুযোগও নেই। এরপর বিশাল একটি বিল, যেটা ওপাশে নদীর সঙ্গে মিশেছে। বিলের ভেতরে একটা খালি নৌকা। আর এক পাশে জাল ফেলে বসে আছেন একজন বৃদ্ধ জেলে।
বছর তিনেক আগে, ঠিক মনে নেই কোন মাসে, এই এলাকায় একবার এসেছিলেন মইন আলী। ঘটনাক্রমে। এখানে আসার কোনো পরিকল্পনাই তার ছিল না। পুলিশই অনেকটা জোরাজুরি করে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল তাকে। এখানকারই কোনো একটা জায়গায় হবে, একেবারে ঠিক এখানে না হলেও হবে আশপাশের কোথাও, মধ্যরাতের পর এক প্লাটুন বাহিনী নিয়ে দুটো জিপ গাড়িতে করে তারা এসেছিল ঝড়ের গতিতে।
কিন্তু আজ তার কিছুই চিনতে পারছেন না মইন আলী। চেনার কথাও না। ওই রাতে আকাশে চাঁদও ছিল না। চারপাশজুড়ে ছিল শুধু অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার। তার ভেতরে ছিল আগুনের ফুলকির মতো সহস্র জোনাকির আলো। মইনের এখনো মনে পড়ে, খুব ঘন ছিল ওই রাত। দুধের সরের মতো জমাট অন্ধকার চিরে জিপের হেডলাইট ও টর্চের আলোতে মইন কত দূর কী দেখেছিলেন, সেসব তার আর মনে নেই। কিন্তু ওই রাতে বুকে কাঁপন ধরানো ঝিঁঝি পোকার বীভৎস সব ডাক তার কানে এখনো গেঁথে আছে।
ফওজিয়া তখন একটু দূরে। ডুবে আছেন নিজের আপন জগতে। এই ভুবন তার নিজস্ব। মইনেরও প্রবেশাধিকার নেই সেখানে। গুনগুন করে গান গাইছেন। একসময় গুটি গুটি পায়ে হারিয়ে গেলেন কাশফুলের ঘন ঝোপের ভেতরে। বেরিয়ে এলেন কিছুক্ষণ পর। মইন তখন পকেট থেকে তার ফোনটা বের করলেন। দূর থেকে কয়েকটা ছবি তুললেন স্ত্রীর। তারপর সদ্য তোলা ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো, বিয়ের দিন যে রকম দেখেছিলেন, ঠিক সে রকমই আছে জয়া (ফওজিয়া), কিন্তু প্রায়ই তার মনে হয়, ফওজিয়া আসলে অনেকখানি বদলে গেছেন!
এতক্ষণে চারপাশের সোনারোদ মরে গেছে। মইন আলী দেখলেন, একটু আগেও যে সূর্যটা তালগাছগুলোর মাথার ওপরে ঝুলেছিল, সেটা খুব দ্রুত নিচের দিকে নামতে লাগল। যেন এখনই ওটা বিলের পানিতে টুপ করে পড়ে যাবে। আজ ওর এত তাড়া কিসের? মইনের মনে পড়ল, লিফটে নামার সময় দেখেছেন, ফওজিয়াও আজ এ রকমই একটা টিপ পরেছেন কপালে।
ওরা যখন হাইওয়েতে উঠে এল, সূর্যটা তখন বিলের পানিতে তার সমস্ত রং গলিয়ে ডুবে গেছে গ্রামের ওপাশে। ধীরে ধীরে চারপাশে ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার। মইন গাড়ির ভেতরে ঢুকে ফওজিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে হেডলাইট অন করলেন। বললেন, ‘এখানে ডিনার করলে কেমন হয়?’
‘এইখানে!’ ভ্রু কুঁচকালেন ফওজিয়া।
হুম্, অসুবিধা কী জয়া? একদিন খেয়েই দেখো না!
পেট খারাপ করবে না তো আবার?
দুনিয়ার মানুষ খাচ্ছে না বুঝি! মইন তার স্ত্রীকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন।
কিন্তু এখনো তো ডিনারের সময় হয়নি।
গাড়ির ড্যাশবোর্ডে সময় দেখলেন মইন আলী। সাতটার মতো বাজে। ‘অসুবিধা নেই। চারপাশে একটা চক্কর দিলে সময় কেটে যাবে, জায়গাটাও দেখা হবে,’ এটুকু বলে হুশ করে হাইওয়েতে ওঠে এলেন মইন।
পাশাপাশি কয়েকটা হোটেল দেখে গাড়ি থামালেন মইন আলী। তার সামনে আরও কিছু গাড়ি এলোপাতাড়ি দাঁড় করানো। একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে প্রথমে চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখলেন তিনি। খুব বেশি ভিড় নেই আজ। দেখলেন দুটো পরিবার পাশাপাশি বসে গল্প করতে করতে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছে।
রেস্তোরাঁর ভেতরে কিছুক্ষণ পায়চারি করে ফওজিয়া কোনার একটি টেবিলে গিয়ে বসেছেন। কখনো কোথাও গেলে তিনি প্রথমে এ রকম একটা নিরিবিলি জায়গা খুঁজে বের করবেন, এটাই যেন ধরাবাঁধা নিয়ম। বাইরে গেলেও লোকজন এড়িয়ে চলবেন ফওজিয়া, কথা বলবেন কম। তার কানের পাশে মানুষের উচ্চকণ্ঠ, চোখের সামনে পরিচিত-অপরিচিত লোকজনের হাঁটাচলা তাকে খুব অস্থির করে তোলে। মইন যখন এসব নিয়ে তার স্ত্রীকে কোনো প্রশ্ন করেন, ফওজিয়ার সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘ভাই, এটা আমার অসুখ। তো আমি কী করব বলো?’
ফওজিয়া আলী তার ছোট্ট পরিবার নিয়ে—পরিবার বলতে শুধু তার স্বামী আর একজন গৃহপরিচারিকা রাসেলের মা—নিজের মতো করে গুটিয়ে থাকতে চান। কিন্তু আগে তিনি এ রকম ছিলেন না। বিয়ের পর মইন দেখেছেন, তার জয়া খুব হাসিখুশি আর প্রাণোচ্ছল ছিল। সব সময় শান্ত-স্নিগ্ধ আর চোখজুড়ানো একটা হাসি লেগে থাকত মুখে। তাকে তো বটেই, বাড়ির সবাইকে মাতিয়ে রাখত সে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স-মাস্টার্স করা ফওজিয়া লেখাপড়া শেষ করে একটা ইংরেজি দৈনিকে চাকরিও নিয়েছিলেন। মফস্বল পাতার এডিটর হিসেবে। নিজের কাজ নিয়ে খুব গর্বও করতেন তিনি। বাড়িতে ফিরে মইনের সঙ্গে সারাক্ষণ বকবক করতেন। এ জন্য মইন কখনো কখনো, মজা করে, তার স্ত্রীকে ‘বিবিসি’ বলেও ডাকতেন। ফওজিয়া তার স্বামীকে বলতেন আজ কোথায় কী কী ঘটেছে, কোন জেলার কোন রিপোর্টার কী খবর পাঠিয়েছে। তারপর মোহাম্মদপুরে, ওরা যেখানে থাকে, তার কাছেই নাকি একজন তরুণ পুলিশের সঙ্গে ক্রসফায়ারে মারা গেছে।
‘আচ্ছা, মইন, তুমি কি কাল রাতে গোলাগুলির শব্দ শুনেছ?’
ওরা তখন খাবার টেবিলে। একটু আগে ফওজিয়া অফিস থেকে ফিরেছেন। কিন্তু অন্যান্য দিনের চেয়ে তাকে একটু বেশি অস্থির লাগছিল। মইনের প্লেটে ভাত তুলে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘কোথায়?’ জানতে চাইলেন মইন।
‘বেড়িবাঁধের ওপারে। রাত দুটা-তিনটা হবে। তখন নাকি সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পুলিশের প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়েছে।’
‘হতে পারে জয়া। সন্ত্রাসীরা আজকাল খুব বেশি ঝামেলা করছে। লোকজনের ঘুম হারাম হওয়ার মতো অবস্থা। ও রকম দু-একটা মরলে তবে শান্তি।’
‘পুলিশের প্রেস রিলিজেও সে রকম লিখেছে। কিন্তু আমাদের রিপোর্টার বলছে, নিহত ছেলেটি বিরোধী দলের। হরতাল হলে ও-ই নাকি রাস্তায় থাকত। তোমাদের দলের এক নেতারও নাকি হাত আছে এই ক্রসফায়ারের পেছনে।’
‘কী যে বলো তুমি, এ-ও কি কখনো হয়, আমরা বললাম আর পুলিশ ঠুস করে মেরে ফেলবে?’
‘আমাদের রিপোর্টার ইনভেস্টিগেট করছে।’
‘করুক, তখন দেখবে যে কেমন সত্যটা বেরিয়ে আসে। কিন্তু এখন তো ঘুমাতে দেবে, নাকি?’
এ রকম আরও কত ধরনের খবর দেন ফওজিয়া তার স্বামীকে। বেশির ভাগ খবরই তিনি স্বামীর সঙ্গে শেয়ার করেন ডিনারের টেবিলে।
এ রকম করেই চলছিল দিন। কিন্তু কয়েক বছর পর হঠাৎ করে কী যেন হলো ফওজিয়ার, একদিন হুট চাকরি ছেড়ে দিলেন। মইন জানতেন না সেটা। এ বিষয়ে তাকে কিছু বলেনওনি ফওজিয়া। মইন দেখলেন, স্ত্রী টানা কয়েক রাত তাকে কোনো খবর দিচ্ছেন না। খাবারের টেবিলে বসে, আর তিনিও তেমন কিছু জানতে চান না। চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে যান বিছানায়। মইনের প্লেটের দিকেও তার চোখ নেই। একদিন, সম্ভবত বুধবার হবে, সেদিন রাতে খুব বিচ্ছিরি একটা গরম পড়েছিল, বিদেশি চ্যানেলে একটা মুভি দেখার পর মইন বিছানায় তার স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হতে হতে জানতে চাইলেন: ‘খবর কী বলো?’
‘তেমন বড় কিছু নেই,’ ফওজিয়ার নির্লিপ্ত উত্তর।
‘কী বলো! বিবিসির কাছে কোনো খবর নেই!’ স্ত্রীকে একটু চাঙা করতে চাইলেন মইন।
‘বিরক্ত করো না মইন, ঘুমাতে দাও তো প্লিজ।’ পাশ ফিরে স্বামীর দিকে পিঠ দিলেন ফওজিয়া।
মইনের তখন আর খবরের প্রতি অতটা আগ্রহ ছিল না, যতটা আগ্রহ ছিল ফওজিয়ার শরীরের জন্য। তৃপ্ত মইন যখন এক পাশে গড়িয়ে ছাদের দিকে মুখ দিয়ে শুয়ে পড়েন, সুখের রেশ তখনো তার শরীরে নদীর স্রোতের মতো পা থেকে মাথা পর্যন্ত কলকল করে বয়ে চলেছে, শরীর ঘেমে গেছে প্রচণ্ড গরমে এবং উত্তেজনায়। এসিটার দিকে তাকালেন তিনি। হিশ হিশ করে একটা শব্দ হচ্ছে। ভাবলেন, তাপমাত্রা আরও একটু কমিয়ে দিলে ভালো হতো। কিন্তু সমস্যা ফওজিয়াকে নিয়ে। এসির বাতাস তিনি মোটেও সহ্য করতে পারেন না। গরমেও কাঁথা লাগে তার। ফওজিয়ার নগ্ন ঊরুর ওপর পা তুলে দিয়ে মইন টের পেলেন, তার স্ত্রীর শরীর ইতিমধ্যেই ঠান্ডা হতে শুরু করেছে।
জংলাছাপ চাদরে পিঠ দিয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকালেন মইন। মশারির নেটের জন্য স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তিনি দেখলেন মশারির গায়ে ফ্যানের ব্লেডগুলো এমন একটা ছায়া তৈরি করেছে যে মনে হচ্ছে একটা মৃতদেহ পড়ে আছে রাস্তার কিনারে। ওই রাতেও ঘুমাতে পারলেন না তিনি।
একদিন দুপুরে ফওজিয়ার কাগজের সম্পাদকের একটা ফোন এল। খচখচ করে উঠল মইনের মন। ওপাশ থেকে সম্পাদক সাহেব তখন নিজের পরিচয় দিলেন: ‘কী সেক্রেটারি সাহেব, অনেক দিন দেখা হয় না আপনার সঙ্গে।’
জবাবে মইন বললেন, ‘জি। কী করতে পারি আপনার জন্য বলুন।’
‘কিছু করতে হবে না আলী ভাই। আপাতত বলেন তো দেখি ফওজিয়ার কী হয়েছে?’
‘কেন সামাদ ভাই?’
‘ও চাকরিটা হুট করে ছেড়ে দিল কেন?’ আকাশ থেকে পড়লেন মইন। এই প্রশ্নটা তার কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু সামলে নিলেন নিজেকে। এই খবরটা যে তার জানা ছিল না, সেটা তিনি সম্পাদক সাহেবকে বুঝতে দিতে চান না।
‘ফওজিয়া খুব ব্রাইট একটা মেয়ে। খুউব ভালো করছিল। মফস্বলের পাতার চেহারাটাই ও বদলে দিয়েছে। আমার সব জেলার করেসপনডেন্টরা ওকে খুব পছন্দ করে।’
চুপ করে রইলেন মইন। স্ত্রীর প্রশংসা শুনতে তার ভালোই লাগছিল।
‘আমি ভাবছিলাম ওকে ফ্রন্ট পেজে নিয়ে আসব। আর তখনই ও রিজাইন করে ফেলল!’ কথার মাঝখানে বাধা না দিয়ে মইন তখনো চুপ করে রইলেন। সম্পাদককে আরও কিছু বলার সুযোগ দিলেন তিনি। ‘এ জন্যই আপনাকে ফোন দিলাম। দেখেন তো বুঝিয়ে-শুনিয়ে যদি ওকে ফেরত পাঠাতে পারেন।’
‘অফিসে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?’ জানতে চান মইন।
‘সে রকম হলে আমাকে ও বলুক। আমি ব্যবস্থা নেব।’ সম্পাদকের উত্তর।
‘দেখি সামাদ ভাই, আমি কী করতে পারি। জানাব আপনাকে।’
এটুকু বলে ফোন রেখে দিলেন মইন আলী। রাতে বাড়িতে ফিরে প্রথমেই কিছু বললেন না স্ত্রীকে। খাবারের সময়ও না। পরে সোফায় ফওজিয়ার কোলের ওপর মাথা রেখে রিমোট টিপতে টিপতে কথাটা পাড়লেন তিনি। ‘জয়া, তোমার কি কোনো সমস্যা হয়েছে?’
‘কিসের সমস্যা!’
‘আমাকে বলতে পারো, আমি তো তোমাকে সাহায্য করতে পারি। নাকি?’
‘কই, আমার তো কোনো সমস্যা হয়নি।’ একটু বিরক্ত ফওজিয়া।
‘তুমি নাকি কাগজের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছ?’
ফওজিয়া আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন যে তাকে এ রকম একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে এখন। আর সে জন্য মনে মনে একটা উত্তরও গুছিয়ে রেখেছিলেন। ‘হুম্, আর ভালো লাগছে না।’
‘আমাকে বলোনি কেন?’
‘বলতাম। বলার সময় তো শেষ হয় যায়নি।’
‘কেন ছাড়লে? অফিসে কি কিছু হয়েছে?’
‘না না, ও রকম কিছু না। আমি ভেবে দেখলাম আমার নিজেকে কিছু সময় দিতে হবে। তোমাকেও সময় দেওয়া দরকার। আমাদের বিয়ের সাত-আট বছর হয়ে গেল। এখন তো একটা সন্তান নেওয়া উচিত, তাই না?’
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইলেন। ফওজিয়া বললেন, ‘এখন না হলে আর কবে হবে।’
‘সময় তো আর শেষ হয়ে যায়নি,’ নির্লিপ্ত কণ্ঠে ফওজিয়ার কথাটা ফিরিয়ে দিলেন তিনি।
মইন আলী তার স্ত্রী ফওজিয়ার সঙ্গে তাদের বাচ্চা না হওয়া নিয়ে খুব বেশি কথা বলেননি কখনো। একেবারেই যে বলেননি তা নয়, বলেছেন, কিন্তু তাতে কখনো এ রকম অভিযোগের সুর ছিল না, বরং তাতে ছিল একে অপরের প্রতি মায়া ও ভালোবাসার প্রকাশ। যদিও এই শূন্যতা একটা গোপন কাঁটার মতোই বিঁধে ছিল তার মনের নরম ভূমিতে। এখন সেই রক্তাক্ত জায়গাটা ফওজিয়া হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলেন সরাসরি।
মইন জানেন যে এই দীর্ঘশ্বাস শুধু তার একার নয়। এই কষ্টটা ফওজিয়ারও সমান। কিন্তু এর জন্য কে দায়ী, সেটা তো তারা কেউই জানেন না। এ রকম কোনো টেস্টও করা হয়নি এখনো। ডাক্তারের কাছে যাব যাব করেও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। মইনের মা ও বোনেরা কয়েকবার প্রশ্নটা তুলেছিলেন, কিন্তু মইন সেটাকে বাড়তে দেননি। শুধু ভেবে রেখেছেন দুজনেই কোনো এক সময়ে সিঙ্গাপুরে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আসবেন।
ফওজিয়ার মুখে বাচ্চা নেওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথা শোনার পর স্ত্রীর চাকরি ছাড়া নিয়ে আর কিছু বলেননি মইন। তিনি জানেন, মেঘের ভেতরে বৃষ্টি জমে থাকার মতো ওই আকাঙ্ক্ষার পেছনেও লুকিয়ে আছে একটা গভীর হতাশা। কিন্তু ফওজিয়া সেই হতাশার কথা তার কাছে গোপন রেখেছেন, যেমনটা রেখেছেন তিনি নিজেও। এক মশারির ভেতরে, এক ফ্যানের নিচে, এক চাদরের উপরে তারা পাশাপাশি থাকেন, কিন্তু তারা কেউই একে অপরের এই দীর্ঘশ্বাস শুনতে পান না। যদিও তারা দুজনেই ভালো করে জানেন যে তাদের মনের গর্তের ভেতরে এ রকম একটা সাপ পেঁচিয়ে আছে। কিন্তু তারা এই সাপকে কখনো খোঁচা দেন না, এই ভয়ে, যদি সে ফোঁস করে জেগে ওঠে।
মইন আলীর নিজের মনটাও তখন একটু খারাপ হয়ে গেল। কী হবে যদি দেখেন যে আসলে তার নিজের শুক্রাণুই এই সবকিছুর মূল কারণ! আর যদি ফওজিয়ার সমস্যাও হয়, তখনই-বা কী করবেন তিনি। তার বুকের ভেতরে এ রকম কিছু প্রশ্ন নিজের অজান্তেই লাউয়ের ডগার মতো লকলক করে বাড়তে থাকে। ফওজিয়ার বুকেও কি এ রকম প্রশ্ন জমে আছে? তারা দুজনেই তো জানেন, বুকের ভেতরে বেড়ে ওঠা এসব গোপন প্রশ্ন হচ্ছে আগাছার মতো। সময়মতো উপড়ে না ফেললে ওরা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়বে যে শেষ পর্যন্ত তাদের নিশ্বাসও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
মইন আলী দেখেছেন, ফওজিয়া আজকাল একা একা থাকতেই পছন্দ করেন বেশি। আজ কত বছর হয়ে গেল ওদের বিয়ে হয়েছে, কিন্তু মাঝেসাঝে মইনেরই ওকে চিনতে অসুবিধা হয়। আগে যে মানুষটা ঘরভর্তি মানুষ নিয়ে হইহুল্লোড়ে মেতে থাকত, সে কিনা এখন ঘরের ছিটকিনি লাগিয়ে ওপাশের বারান্দায় চুপচাপ বসে দূরের বাড়িঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এ জন্য মইন একদিন তার স্ত্রীকে রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘জয়া, তুমি তো একটা চড়ুই পাখির মতো চঞ্চল ছিলে একসময়, কিন্তু হঠাৎ এমন শামুক হয়ে গেলে কেন?’ এই কথায় ফওজিয়া রাগ করেন না, আবার খুশিও হন না। ফওজিয়ার হুট করে এই জীবন বেছে নেওয়ার পেছনে যে কারণ, সেটা এই পৃথিবীতে একমাত্র তিনিই জানেন।
খোঁটা দিয়েও নিজের স্ত্রীকে যখন উত্তেজিত করতে পারেন না, তখন মইন আলী নিজেও একবার ভাবেন যে তার জীবনটাও যদি এ রকম শামুকের মতো হতো, তাহলে খুব একটা মন্দ হতো না। ইদানীং তার নিজেরও মনে হয় যে জীবনটা অনেক বেশি জটিল আর ঘোলাটে হয়ে গেছে। কীভাবে কীভাবে যে এমন হয়ে গেল, সেটা তিনি নিজেও বুঝতে পারেন না।
একটার পর একটা ঘটনা তাকে আজ এত দূর নিয়ে এসেছে। তার জীবন শুরুতে এ রকম ছিল না। হুট করেই কোনো একটা ঘটনা থেকে শুরু হয়েছে তার এই নতুন জীবন। শিকলের একটা রিং যেমন আরেকটা রিংকে পেঁচিয়ে নিজে টিকে থাকে, তেমনি তার জীবনেরও একটা ঘটনা, আরেকটা ঘটনাকে আঁকড়ে ধরে তাকে টিকিয়ে রেখেছে। এই জট খোলার এখন আর কোনো উপায় দেখছেন না তিনি। মইন আলীর কখনো কখনো মনে হয় শিকল ভেঙে একদিন ঠিক ঠিক এই জীবন থেকে নিঃশব্দে পালিয়ে যাবেন তিনি। কিন্তু ভয় পান। সে এক ভয়ানক ভয়।
এই ভয় বর্ণনা করার ভাষা তার নেই। শুধু তা-ই নয়, এই ভয়ের কথা শেয়ার করারও কোনো মানুষ নেই তার জীবনে। এমনকি ফওজিয়াও না। কোনো কোনো রাতে ভয়ের চোটে ঘুম ভেঙে যায় মইনের। অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন তিনি। একদিন দেখলেন একদল লোক তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের ভেতরে। তার হাত দুটো পিঠমোড়া করে বাঁধা। তাকে বলা হলো দৌড়াতে কিন্তু তিনি দৌড়াতে পারছেন না। তার পা ভেঙে যাচ্ছে। আরেক রাতে দেখলেন তার মৃতদেহ পড়ে আছে জলমগ্ন ধানখেতের ভেতরে। তখন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে শিয়ালের ডাক। ওই ডাকে স্বপ্ন ভেঙে গেলে বিছানায় উঠে বসে থাকেন তিনি। দেয়ালের এক পাশে জানালার ওপরে হিশ হিশ করে এসি চলছে, কিন্তু তারপরও ঘামে ভিজে যায় তার শরীর। ফওজিয়াকে ডেকে তোলারও সাহস পান না। ডেকে কী বলবেন তাকে? কখনো কখনো এমনও রাত গেছে যে মইন আলী বিছানা ছেড়ে ঘর থেকে উঠে গিয়ে বসে থেকেছেন সিটিং রুমের সোফায়, কিংবা বেডরুম লাগোয়া ছোট্ট বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। রাতের আকাশে দেখেছেন ভেসে যাওয়া কালো মেঘ, তার ভেতরেও ওত পেতে ছিল ভয়। হঠাৎ একখণ্ড মেঘকে তার মনে হলো চিত হয়ে পড়ে থাকা একটা লাশ, সেখানে চাঁদের আলো এমনভাবে পড়েছে যেন গড়িয়ে পড়ছে রক্তের স্রোত। ইঁদুরের মতো ছুটে পালিয়ে এলেন ঘরের ভেতরে। আরও একটা রাত নির্ঘুম কাটল মইন আলীর।
রেস্তোরাঁর রেডিওতে তখন কী একটা অনুষ্ঠান চলছে। শোনো, স্বামীকে ডাকেন ফওজিয়া। বললেন,‘খুব বেশি কিছু অর্ডার দিয়ো না।’
‘কী খেতে চাও?’
‘এনিথিং, তুমি পছন্দমতো বলে দাও।’
এখানে মইন কয়েক বিঘা জমি কেনার পরিকল্পনা করছেন। কিছু জায়গা দেখেও রেখেছেন। মনে মনে সিদ্ধান্তও নিয়ে নিয়েছেন কেনার। কিন্তু ফওজিয়াকে দেখানো তো দূরের কথা, এ নিয়ে তাকে কিছু বলাও হয়নি। মইন ভেবে রেখেছেন, আজ এখানে বসে, খেতে খেতে জমি কেনার পরিকল্পনার কথাটা তিনি তার স্ত্রীকে জানাবেন।
শিমভর্তা, ডালভর্তা, লাউ দিয়ে মাগুর মাছের ঝোলের মতো একটা তরকারি, দুই বাটি চিকেন আর দুই প্লেট ভাত দেওয়ার কথা বললেন মইন আলী। দেখলেন কিছু মাছি বড় বড় খাবারের ডালাগুলোর ওপর ভনভন করে উড়ছে। দেখে একটু ইতস্তত করলেন তিনি। একটা ছোট ছেলে বসেছিল খাবারগুলোর ওপাশে। সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালেন মইন। বললেন, ‘এই, এগুলো কবের তরকারি?’
‘ছার, আইজকাই রানছে’, ছেলেটি তড়িঘড়ি করে উত্তর দিল।
‘মাছি ক্যান এত? খাবার ঢাইকা রাখতে পারস না?’
ছেলেটি মাথা নিচু করে বসে রইল। কোনো উত্তর দেওয়ার সাহস নেই ওর। দূরে বড় বড় পাত্রে খাবার গোছগাছ করছিল মধ্যবয়সী এক লোক, দোকানের ম্যানেজার।
মইন আলী কার কাছ থেকে জমি নেবেন, সেটা মোটামুটি ঠিকই হয়ে আছে। তারই এক বন্ধু, যে এখন পুলিশে আছে, ওই লোকের খোঁজ দিয়েছে তাকে। দুই বিঘার বেশি হবে। কথা মোটামুটি ফাইনাল। জমির মালিক কয়েক মাস ধরে আছে জেলখানায়। প্রথমে তার নামে কয়েকটা কেস দেওয়া হয়েছে। তারপর হয়েছে আপসরফা। এখন শুধু জামিনের জন্য অপেক্ষা। ওটা ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলেই জমির রেজিস্ট্রেশন।
খেতে খেতে মইন তার স্ত্রীকে জমির কথাটা বললেন। ফওজিয়া প্রথমে একটু আপত্তি তুলেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন দুই বিঘা জমি কেনার টাকা তিনি পাবেন কোথায়। ঢাকা শহর এখন যত দ্রুতগতিতে বাড়ছে, আর জমির যে চাহিদা তাতে এখনকার দুই বিঘার দাম কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ‘তুমি ওসব নিয়ে ভেবো না জয়া। ম্যানেজ হয়ে যাবে,’ এইটুকু বলে মাছের একটা কাঁটা দাঁত দিয়ে চেপে মইন তাকালেন ফওজিয়ার চোখের দিকে। কিন্তু পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে নিলেন। পারলেন না তাকিয়ে থাকতে। দেখলেন ফওজিয়ার চোখে অবিশ্বাস স্পষ্ট।
মইন আলী আর স্ত্রীকে সবকিছু বলেননি। কারণ, ঘটনাপ্রবাহে জীবনের যে পঙ্কিলতায় তিনি ডুবে গেছেন, সেটা তিনি নিজের কাছেও গোপন রাখতে চান। তবে তিনি এটাও জানেন, এখন যে পদে তিনি আছেন, সেটা তার জীবনে আলাদিনের চেরাগের মতো। এই চেরাগ সব সময় পাওয়া যায় না। ফলে যা ঘষা দেওয়ার, সেটা দিতে হবে এখনই। পরে দিন-রাত চেরাগ ঘষলেও এই দৈত্য আর কখনো আসবে না।
ফওজিয়া জানেন না যে এই দৈত্যই এর মধ্যে ঢাকায় তাদের দুটো ফ্ল্যাট এনে দিয়েছে। সেগুনবাগিচার অ্যাপার্টমেন্টের কথা শুধু ফওজিয়া জানেন। তাকে বলতে হয়েছিল কারণ দৈত্যটা মইনকে বলেছে ওই ফ্ল্যাট তার স্ত্রীর নামে রেজিস্ট্রেশন করাতে। দৈত্যটা গাজীপুরেও তাকে দুই একর জমি জোগাড় করে দিয়েছে, সেটাও জানেন না তিনি। আর এখন তো তার স্বামীর হাতে এনে দিয়েছে এই কেসটাও। তার জের ধরে যে জমিটা একেবারে হাতের নাগালের কাছে, তার কথা আজই মইন আলী একটু একটু করে তার স্ত্রীকে বলতে শুরু করেছেন।
‘জয়া,’ খেতে খেতে মুখ তুলে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মইন বলতে লাগলেন, ‘এখানে যে জমিটা হবে সেটা তোমার নামেই করে দিই, কী বলো?’ স্ত্রীর উত্তরের অপেক্ষা না করে তিনি বলতে লাগলেন, ‘আমার নামে হলে যদি পরে ঝামেলা হয়। যদি এটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে। শুরু থেকেই সবকিছু গুছিয়ে রাখা ভালো।’
এবারও কিছু বললেন না ফওজিয়া। বরং বলতে থাকলেন মইন, ‘কয়েক মাসের মধ্যেই সব ফাইনাল হয়ে যাবে। তোমাকে বেশি কিছু করতে হবে না। একটা কাগজে সই করতে হবে শুধু। আর একদিন রেজিস্ট্রেশনের জন্য তোমাকে ভূমি অফিসে নিয়ে যাব, ব্যস, এতটুকুই।’
কথা বলতে বলতে মইন আলী দেখলেন, ফওজিয়ার বাঁ পাশে একটা লোক এসে বসেছে। বয়সে তরুণ। গায়ের জামাকাপড়ও খুব একটা পরিষ্কার নয়। রুক্ষ মুখ। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মইন একবার লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলেন। কিন্তু কেমন খচখচ করে উঠল তার মনের ভেতরে। লোকটাকে চেনা চেনা মনে হলো তার। কিন্তু মনে করতে পারলেন না, কে এই তরুণ। এ জন্য তার একটু অস্বস্তি হলো। লোকটার ওপর থেকে মনোযোগ অন্যত্র সরিয়ে ফেলতে চাইলেন তিনি। ফওজিয়াই তখন তার সাহায্যে এগিয়ে এলেন, ‘এত কিছু দিয়ে তুমি কী করবে মইন?’
‘কী যে বলো না জয়া, এত কিছু কই দেখলা তুমি?’
‘এই যে ফ্ল্যাট, জমিজমা এসব দিয়ে কী করবা?’
‘কেন বলো তো, তুমি মনে হয় অনেক বড়লোক হয়ে গেছ? আমি ভাই গরিব মানুষ। অনেক সংগ্রাম করে এখানে এসেছি। আমাদের পরিবারের কথা তুমি জানো। তোমাকে বলেছি কেমন ছিল আমার ছোটবেলা। এখন যদি একটা কিছু করতে চাই, তাহলে কি সেটা দোষের?’
‘আমি তো তোমাকে কোনো দোষ দিইনি মইন। শুধু বলেছি, এত কিছু দিয়ে করবেটা কী! আমাদের তো আর কেউ নেই। তুমি আমি ছাড়া।’
ধক করে উঠল মইন আলীর বুকের ভেতরে। মনে হলো তার স্ত্রী তাকে খোঁচা দিচ্ছে। কেউ নেই মানে তো সন্তান না হওয়া। ফওজিয়া বুঝি পরোক্ষভাবে বলতে চাইছে তাকে সন্তান দেওয়ার কোনো ক্ষমতা তার নেই। কিন্তু কীভাবে? সেটা তো তারা জানেন না এখনো। আর এখন কেউ নেই মানে তো এই নয় যে ভবিষ্যতেও তাদের কেউ হবে না। জীবন তো শেষ হয়ে যায়নি মোটেও।
এর কয়েক দিন পর, তারা বসেছিলেন বারান্দায়, পাশাপাশি দুটো বেতের চেয়ারে। খুব ভেঙে পড়েছিলেন ফওজিয়া। কাঁদতে কাঁদতে ফওজিয়া মইনকে বলেছিলেন, ‘চলো, আমরা এখান থেকে চলে যাই। তুমি অন্য কিছু করো মইন।’
‘কেন, এখানে কী অসুবিধা হচ্ছে তোমার, বলো?’
‘জানি না, আমার ভালো লাগছে না। শ্বাস নিতে পারি না।’
‘কী যে ছেলেমানুষি করো তুমি জয়া!’
ফওজিয়া তখন তার স্বামীকে পুরো বিষয়টা খুলে বলার প্রস্তুতি নিলেন। উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার থেকে। এক পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। কয়েক মাস আগে ওখানে একটা টবে লেবুগাছ লাগিয়েছিলেন ফওজিয়া। গাছটা এখন বেশ বড় হয়েছে। ফুল ধরেছে কিছু। তার হালকা একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।
‘মিরপুরের সুমন কোথায় আছে তুমি কি জানো, মইন?’
‘হু ইজ সুমন?’
‘যে ছেলেটা বাড়ি থেকে হঠাৎ গুম হয়ে গেল। ওর মা বলছে, সাদাপোশাকের একদল লোক ওকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু পুলিশ বলছে ওরা কিচ্ছু জানে না।’ ফওজিয়ার গলা এখন ভারী।
‘আমি কীভাবে জানব জয়া? আমি কি তোমাদের মতো সাংবাদিক নাকি?’ খুব দ্রুত উত্তর দিলেন মইন আলী।
‘সাংবাদিকেরা যা জানে না তোমরা পলিটিশিয়ানরা সেটা জানো, মইন।’
‘জয়া, তোমার এসব কথার কোনো মানে বুঝতে পারছি না।’
এরপর তিনি ‘এসব কথার’ অর্থ বোঝাতে পুরো ঘটনা খুলে বললেন তার স্বামীকে। ‘তুমি কি জানো আমি কেন চাকরি ছেড়ে দিয়েছি? জানো না। আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি কারণ যে খবর আমি ছেপেছি, সেটা আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কিন্তু বিশ্বাস না করেও উপায় ছিল না। আমি নিজে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে খোঁজ নিয়েছিলাম। অনেক জায়গা থেকেই তোমার নামটা বলা হয়েছে। আমাদের রিপোর্টার যে খবর দিয়েছে, তাতে আরও কয়েকটা নামের সঙ্গে তোমার নামও ছিল মইন। রাস্তা পরিষ্কার রাখতে তোমরা ওকে সরিয়ে দিয়েছ।’
এটুকু বলে ফওজিয়া আকাশের দিকে তাকালেন। পরিষ্কার নীল আকাশ ছিল একটু আগেও। কিন্তু এখন সেখানে ভিড় করেছে ছাইরঙা কিছু মেঘ। মইন দেখলেন, একটা মেঘ আরেকটা মেঘের ভেতরে এমনভাবে ঢুকে গেছে, মনে হচ্ছে অন্তঃসত্ত্বা এক নারী পরির মতো উড়ে যাচ্ছে আকাশে।
‘মইন, তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও।’
‘কী বলছ তুমি!’
‘আমি যা বলছি, সেটা খুব পরিষ্কার এবং সহজ। ইউ শুড লিভ পলিটিকস।’
‘চাইলেই ছাড়া যায় না জয়া। এটা আমার রক্তের সঙ্গে মিশে আছে।’
‘চেষ্টা করে দেখো, না পারলে চলো আমরা বিদেশে চলে যাই।’
মইন আলী চেয়ার থেকে উঠে এসে ফওজিয়ার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। দুহাতে আঁজলা করে ধরার চেষ্টা করলেন তার মুখ। ফওজিয়া তার ডান হাত দিয়ে একঝটকায় ঠেলে সরিয়ে দিলেন মইনের হাত। ‘তুমি যা শুনেছ সব মিথ্যা জয়া। সব মিথ্যা। বিশ্বাস করো তুমি। প্লিজ, বিশ্বাস করো,’ বলতে বলতে আরও সামনের দিকে এগিয়ে ফওজিয়াকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। ফওজিয়া তখন আছড়ে পড়েছে তার স্বামীর বুকের ওপর। মইন টের পেলেন ফওজিয়ার কান্নার দমকে তার শরীরটাও কাঁপছে। শুনতে পেলেন আকাশে তখন থেমে থেমে গুলি হওয়ার মতো গুড়গুড় করে মেঘ ডাকছে।
রেস্তোরাঁয় ফওজিয়ার পাশে বসা লোকটার দিকে আবারও তাকালেন মইন আলী। ভাবলেন কোথায় দেখেছেন তাকে। ভেবে ভেবে ভেতরটা প্রচণ্ড অস্থির হয়ে গেল তার। মাথায় যখন একটা কিছু ঢোকে, সেটা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত নিস্তার নেই তার। মইন তখন খাওয়ায় মনোযোগ দিতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না। নিজের অজান্তেই বারবার তার চোখ চলে যাচ্ছে ওই তরুণের মুখের ওপর। যতবারই তিনি তার দিকে তাকিয়েছেন ততবারই দেখেছেন যে সে-ও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মইনই চোখ নামিয়ে নিয়েছেন প্রতিবার।
কোথায় দেখেছেন তাকে, কোথায়, কোন জায়গায়, কে এই তরুণ? কার মতো এই এক জোড়া চোখ? এর আগে তো কোনো মানুষ তাকে এভাবে টানেনি কখনো, কিন্তু একটু আগে উড়ে এসে জুড়ে বসা এই লোকটি যেভাবে বারবার তার দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে, মনে হচ্ছে সে-ই তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু সেই চোখের দিকে তাকাতেও অসুবিধা হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে, অচেনা ওই যুবকের চাহনিতে হাজার হাজার তির। আর সেগুলো তীব্রগতিতে ছুটে আসছে তার দিকে।
মইন আলীর মনে পড়ল তিন বছর আগের এক রাতের কথা। একটা ফোন পেয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন তিনি। তাকে খবর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। প্রথমে বলা হয়েছিল, শুধু থানায় গেলেই চলবে। একজন ‘সন্ত্রাসীর’ নাম-পরিচয় নিশ্চিত করেই ফিরে আসবেন তিনি। কিন্তু পরে ঘটনা মোড় নিল অন্যদিকে। তখন কোনো কিছুর ওপরেই নিয়ন্ত্রণ রইল না মইনের। তাকেও যেতে হয়েছিল পুলিশের সঙ্গে। অমাবস্যার রাত ছিল সেদিন। দুটো দলে বের হয়েছিল তারা। দুটো গাড়িতে ছিল তাদের দল। সামনেরটাতে ছিলেন মইন, এসআই জমির এবং আরও তিন–চারজন পুলিশ। একজন তরুণ ছিল তাদের সঙ্গে। নাম: হামিদুল ইসলাম। ওর নামে তেজগাঁও থানায় একটা মার্ডার কেস দেওয়া হয়েছিল প্রথমে। তারপর বহু খোঁজাখুঁজি করে মাত্র দুদিন আগে তাকে পাওয়া গিয়েছিল মগবাজারের একটা আবাসিক হোটেলে। হাতে পাওয়ার পর তাকে আর আদালতে তোলা হয়নি। দুই রাতই সে ছিল থানার গারদে।
তাকে এই হামিদুলের কথা বলেছিলেন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী সাজ্জাদ হোসেন। এর কয়েক দিন আগে তার কিছু কাজ করে দিয়েছিলেন মইন আলী। তিতাসের অফিসারদের বড় অঙ্কের ঘুষ দিয়ে তার কারখানায় লাগিয়ে দিয়েছিলেন গ্যাসের কানেকশন। ব্যবস্থা করে দিয়েছেন সোনালী ব্যাংক থেকে ৫ কোটি টাকা লোনেরও। সে সময় কিছু টাকা নিজের পকেটেও ঢুকিয়েছিলেন মইন। সাজ্জাদ সাহেবই তাকে টাকাটা দিয়েছিলেন। এভাবে-সেভাবে তাদের মধ্যে একটা ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে। ঠিক বন্ধুত্ব নয়, আসলে গড়ে উঠেছিল ব্যবসায়িক সম্পর্ক। একদিন সচিবালয়ে মন্ত্রীর অফিসে দেখা করার পর তারা যখন ফিরছিলেন, সাজ্জাদ সাহেবই মইনকে লিফট দিতে চাইলেন। হিমশীতল ফোর হুইল এসইউভির ভেতরে বসে সেদিন কথা হয়েছিল তাদের।
‘আমি একটা বড় ঝামেলায় পড়েছি ভাই।’
‘আরে ভাই, আপনার তো দেখি সমস্যার শেষ নাই।’ শাহবাগের কাছে যানজটে আটকে ছিল তাদের গাড়ি।
‘আসেন এই ব্যবসায়, তখন বুঝবেন,’ সাজ্জাদ সাহেবের মুখে হাসি।
‘না ভাই, আমারে দিয়ে ওটা হবে না। বলেন দেখি কিসের সমস্যা?’ জানতে চাইলেন মইন আলী।
‘ভাই, চাঁদাবাজির জন্য ব্যবসা করা আজকাল খুব কঠিন। প্রত্যেক মাসে চায়। প্রথমে চায় পঞ্চাশ হাজার। তারপর দাবি করে এক লাখ। আমি তো আর টাকার আড়ত নিয়া বসি নাই।’
তখনই হামিদুলের কথা বলেছিলেন সাজ্জাদ সাহেব। বলেছিলেন, ‘একটা কিছু করেন ভাই। যা লাগে আমি সব দিব।’
ওই হামিদুলের সঙ্গে কি এই তরুণের চেহারার মিল আছে? কিন্তু কীভাবে সম্ভব! সে তো...ভাবনার চোরাবালিতে মইন একটু একটু করে ডুবে যেতে লাগলেন। মনে হলো তার পায়ের তলা থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে মাটি। যেকোনোভাবেই হোক তাকে এখন শক্ত কিছুর ওপর দাঁড়াতে হবে। পা দুটো নেড়েচেড়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগলেন তিনি, যেকোনো কিছু, তার নাম, পরিচয়, ঠিকানা যা কিছু পাওয়া যায়। তিনি চেষ্টা করতে লাগলেন ওই রাতে যে ‘সন্ত্রাসীকে’ সঙ্গে নিয়ে তারা অপারেশনে বের হয়েছিলেন, তার মুখটা মনে করতে। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলেন ন। চোখ দুটো মনে পড়ছে তো নাকটা মনে হচ্ছে অন্য রকম, চুল তো কোঁকড়ানো ছিল, কিন্তু এর তো মাথায় চুলই নেই, ন্যাড়া। তাহলে? তার মনে পড়ল, ওই যুবকের নাম ছিল হামিদুল ইসলাম ওরফে মনির ওরফে কাইল্লা মনির। ওর গায়ের রংও কি এই লোকটার মতো কালো ছিল? কে জানে! রাতের অন্ধকারে ঠিকমতো দেখাও হয়নি।
‘এই যে ভাই, আপনার নাম কী?’ জিজ্ঞেস করলেন মইন আলী।
লোকটা কোনো জবাব দিল না। কিন্তু তার চোখে-মুখে তখনো লেগে আছে সেই একই হাসি।
‘হাসেন ক্যান? আপনার নাম জিজ্ঞেস করলাম না?’ অস্থির হয়ে পড়লেন মইন। কিন্তু লোকটা তখনো নির্বিকার।
ফওজিয়া দেখলেন তার স্বামী উত্তর না পেয়ে রাগে ফুঁসছে। তার চোখে-মুখেও সেটা স্পষ্ট। প্রশ্ন করলে উত্তর না পাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই মইনের। ফওজিয়া তা জানেন, এটা তিনি তার সংসারেও দেখেছেন।
মইন আলীর মনে পড়ল, ওই রাতে জিপটা নিয়ে তারা মূল সড়ক থেকে নেমে গিয়েছিলে একটা বিরানখেতের ভেতরে। তারপর সোজা গিয়েছিল আরও দশ মিনিট। জিপের ভেতরে চুপ করে বসে ছিল কাইল্লা মনির। নড়াচড়াও করেনি। তার হাত দুটো পিঠমোড়া করে বাঁধা ছিল। খালি গা। ছুরি দিয়ে কাটা লম্বা একটা দাগ ছিল বুকের ওপরে। সেলাইয়ের দাগটা দেখে চমকে উঠেছিলেন মইন। বুঝতে পেরেছিলেন বুকের বেশ ভেতরেই ঢুকে গিয়েছিল ছুরিটা। তারপরও সে কীভাবে বেঁচে গিয়েছিল একমাত্র আল্লাহই জানেন!
খাবার রেখে উঠে দাঁড়িয়েছেন মইন আলী। সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন ওই তরুণের সামনে। ‘এই শালা, তোর নাম জিগাইছি?’কোনো উত্তর এল না এই প্রশ্নেরও। বরং এল আরও এক দফা হাসি। চট করে রক্ত উঠে গেল তার মাথায়। মইন ততক্ষণে লোকটার কলার চেপে ধরেছেন। ফওজিয়া অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন এ রকম আকস্মিক ঘটনায়। দ্রুত এগিয়ে গেলেন সামনে। আশপাশের লোকজনও ত্রস্তব্যস্ত হয়ে উঠল। কিন্তু কেউ এগিয়ে যাওয়ার সাহস পেল না।
‘করছ কী তুমি, ছাড়ো।’ ফওজিয়ার অনুরোধ।
‘দেখেছ তুমি, কত বড় বেয়াদব? কয়বার জিজ্ঞেস করলাম নামটা, তুমিই বলো জয়া? জবাব দেয় না, শুধু হাসে। শালা দেখাচ্ছি মজা।’ ষাঁড়ের মতো ফুঁসে উঠলেন মইন আলী। তারপর বলতে লাগলেন, ‘শুয়োরের বাচ্চা, তুই চিনস আমারে? কে আমি, জানস?’
ফওজিয়া তার স্বামীকে টেনে নিয়ে গেলেন লোকটার কাছ থেকে। গ্লাসের পানি ঢেলে হাতটা ধুইয়ে দিলেন তার। তারপর শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে স্বামীর হাত ধরে টানতে লাগলেন। তরকারির হলুদ দাগ তখনো লেগে আছে মইনের আঙুলের ফাঁকে। ‘তুমি যে কী করো না মইন! বেশি বেশি!’
স্বামীকে শাসালেন ফওজিয়া, ‘কোথায় কার সঙ্গে কী করতে হবে, সেটাও বুঝতে পারো না।’
হাত ধরে একটু দূরে টেনে নিয়ে গিয়ে আরেকটা টুলে বসিয়ে দিলেন স্বামীকে। ফওজিয়াও তার সামনে বসে চারদিকে তাকালেন। দেখলেন সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
মইন আলী চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করলেন, ওই রাতে এরপর কী কী হয়েছিল। কাইল্লা মনিরকে তারা নিয়ে গিয়েছিল একটা বিলের ধারে। তারপর খুলে দিয়েছিল হাতের বাঁধন। চারপাশে ঝিঁঝি পোকার ডাক অসহ্য লাগছিল তার। মনে হচ্ছিল পোকাগুলো তার কানের সামনে জড়ো হয়ে চিৎকার করছে। সেই ডাক গিয়ে লাগছিল তার মগজের ভেতরে। ওই রাতে খুব বেশি দেরি করতে চাননি মইন। এত দূরে আসারও কথা ছিল না তার। কথা ছিল শুধু হামিদুলকে শনাক্ত করেই তিনি ফিরে যাবেন বাড়িতে। কিন্তু কী থেকে যে কী হয়ে গেল। একসময় তিনিও উঠে পড়লেন পুলিশের গাড়িতে। তার মনে আছে, কাইল্লা মনির এসআই জমিরকে শুধু বলছিল, ‘ছার, আমারে মাইরেন না ছার। আমারে কোর্টে দ্যান। জেলে দ্যান। আমারে মাইরেন না ছার।’
হামিদুলের ওই কাকুতি–মিনতি চাপা পড়ে গিয়েছিল ঝিঁঝি পোকার কুৎসিত ডাকের আড়ালে।
তারপর মনিরের হাত দুটো খুলে বলা হয়েছিল দৌড় দিতে। সে দৌড়ায়নি তখনো। বরং দাঁড়িয়ে ছিল ওদের সামনেই। এক ফাঁকে বসে পড়েছিল মাটিতে। মইন আর এসআই জমিরের পা-ও জড়িয়ে ধরেছিল কয়েকবার। কিন্তু তাকে মাটি থেকে উঠিয়ে ধমকের সুরে বলা হয়েছিল দৌড় দিতে। ‘শুয়োরের বাচ্চা দৌড়া...এইখান থাইক্কা...পালা, খানকির পোলা।’
‘ছার, আমারে মাইরেন না ছার,’ কাঁদতে লাগল হামিদুল। এসআই জমির তখন তার পাছায় একটা লাথি দিলে সে কাদার মধ্যে উল্টো হয়ে পড়ে গেল। ‘চুতমারানির পোলা দৌড়া। নাইলে মরবি। যা ভাগ।’
হামিদুল তখন দিল দৌড়। বিলের পাড় ধরে ছিল সেই দৌড়। নরম মাটির ভেতরে বসে যাচ্ছিল হামিদুলের পা। দৌড়াতে পারছিল না ঠিকমতো। একবার দুবার পড়ে গিয়ে সে কোনোরকমে উঠে আবারও দৌড়াতে শুরু করল।
এর কিছুক্ষণ পরেই একটা গুলির আওয়াজ হলো। তারপর আরও একটা। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে শোনা গেল আরও একটা আওয়াজ। মোট তিনটা। গুলির আওয়াজ বিলের ওপারের কয়েকটা বাড়িঘরে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল মইনের কানে। সে সময় ভয়ে চুপ করে গিয়েছিল সব ঝিঁঝি পোকাও। রাতের সেই নিস্তব্ধতা কাচের গ্লাসের মতো চুরমার করে ভেঙে দিয়ে এলোপাতাড়ি বেজে উঠল এস আই জমিরের হুইসেল।
‘এই তোরা লাশ ওঠা।’
‘খাতায় কী লিখমু স্যার,’ একজন জানতে চাইল। এসআই জমির তখন টর্চলাইটটা ধরে রেখেছে পুলিশের রেকর্ডবুকের ওপর। আর সেখানে খস খস করে লেখা হলো—একটা পিস্তল, এক ডজন বিচি আর ৫০টা ইয়াবা।
‘তিনটা খোসা পাস কি না দেখ,’ বললেন এসআই জমির।
মইন আলীর মনে হলো, এই তরুণই কি ওই রাতের হামিদুল ওরফে কাইল্লা মনির? তার সঙ্গে তো তিনি এখন অনেক কিছুরই মিল পাচ্ছেন। মনে হচ্ছে ওদের গায়ের রং এক, চোখটাও তার চোখের মতো। ওই রাতে সে যখন ‘আমারে মাইরেন না, ছার আমারে মাইরেন না’ বলে জীবন ভিক্ষা চাইছিল, তখন তার চোখ দুটোও এই যুবকের চোখের মতোই লাগছিল। একই রকমের উজ্জ্বল আর একই রকমের জলে টলমল দুটো চোখ। কিন্তু সেটা তো কিছুতেই সম্ভব নয়। পোস্টমর্টেমের পর ওর লাশ তুলে দেওয়া হয়েছিল আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে। ওরা তাকে কবর দিয়েছে আজিমপুর কবরস্থানে।
আরেকবার নিশ্চিত হতে মইন আলী তাকালেন ওই তরুণের দিকে। দেখলেন তার চোখ দুটো লাল। রক্তজবার মতো। তার মনে পড়ল হামিদুলের ভয়ার্ত মুখ। কিন্তু এই তরুণের মুখেও সেই একই হাসি। মইনের মনে হলো, সে তাকে ব্যঙ্গ করছে। মাথায় চড়াৎ করে আবার রক্ত উঠে গেল তার। মুহূর্তে ছুটে গেলেন ওই তরুণের কাছে। ঠাস ঠাস করে দুটো চড় মারলেন দুই গালে। হোটেলের ম্যানেজার দৌড়ে গিয়ে মইনের হাত থেকে ওই তরুণকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল।
‘কী করেন ছার, ছাড়েন ওরে,’ ম্যানেজার অনুরোধ করল।
‘আপনেরা দেখেছেন, কেমন বেয়াদব পোলা।
কতবার নাম জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু কিছুই বলে না।’
ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন লোক এগিয়ে গেল ওদের সামনে। সবাই মিলে লোকটিকে মইন আলীর থাবা থেকে ছাড়িয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
ফওজিয়া দেখলেন, ধস্তাধস্তিতে তরুণের শার্টের সামনের দিকে ওপরের সব কটি বোতাম ছিঁড়ে গেছে।
‘ছার, হেয় তো বোবা, কথা কইতে পারে না।’
উত্তেজনা আর হই–হট্টগোলের মধ্যে মইন আলী দূর থেকে ম্যানেজারের এই কথাটা ঠিকমতো শুনলেন কি না বোঝা গেল না।
কিন্তু তিনি দেখতে পেলেন, তরুণের শার্টটা যেখানে ছিঁড়েছে, সেখানে—ঠিক বুকের মাঝখানে, ছুরি দিয়ে বসানো একটা লম্বা কাটা দাগ। সেলাই দেখেও বোঝা যায় বুকের ওই ক্ষত কতটা গভীর ছিল।
খুব একটা বাড়িঘর ওঠেনি। মূল সড়ক থেকে একটু ভেতরের দিকে গেলে চোখে পড়বে দু-একটা পাকা দালান।
শেষ হয়নি সেগুলোর নির্মাণকাজও। কঙ্কালসদৃশ এসব ভবনের চারপাশ থেকে হাড়গোড়ের মতো বেরিয়ে আছে কোথাও লম্বা, আবার কোথাও ছোট-বড়, মোটা-চিকন রড।
গায়ে সিমেন্টের পলেস্তারা পড়েনি ঠিকমতো। শুধু কাঠামোটা দাঁড়িয়ে আছে।
এই নগ্ন নির্জন বাড়িগুলোর আশপাশের কয়েকটা প্লটে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো চোখে পড়বে বালুর স্তূপ। কোথাও সারি সারি করে রাখা আছে ইট। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সেগুলোর গায়েও সবুজ শেওলা পড়ে গেছে। আরও আছে লম্বা লম্বা ঘাস।
এসবের ভেতর দিয়ে চলে গেছে মাটির সরু রাস্তা। তার গায়ে বড় বড় গর্ত। গর্তের ভেতরে বৃষ্টির পানি জমে একেকটা ছোটখাটো পুকুর।
রাস্তার দুপাশে কখনো কখনো ঘন কাশবন। এর ভেতর দিয়েই দিনের বেলায় দু-একটা ট্রাককে খ্যাপা ষাঁড়ের মতো চারপাশের সবকিছু দুমড়ে-মুচড়ে ছুটে যেতে দেখা যায়।
অনেক দিন পর এই এলাকায় ঘুরতে এসেছেন মইন আলী। শুক্রবার হলে সপরিবার কোথাও না কোথাও বেড়াতে যান তিনি। দূরে কোথাও না গেলেও অন্তত বাড়ির কাছেই কোনো একটা রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয় তাদের। মইনই আজ প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন তার স্ত্রীকে: ‘চলো, আজ শহরের বাইরে কোথাও থেকে ঘুরে আসি।’
‘বাইরে কোথায়? বেশি দূরে?’
‘না না, বেশি দূর না, এই তো এয়ারপোর্টটা পার হলেই হাতের বাঁয়ে পড়বে। এলাকাটার কথা অনেক শুনেছি। কিন্তু কখনো যাওয়া হয়নি, ‘ওয়ার্ডরোব থেকে নতুন একটা শার্ট বের করে তার ভাঁজ খুলতে খুলতে মইন বললেন, ‘গিয়েছিলাম একবার। কিন্তু অনেক আগে। রাতের বেলায় বলে ঠিকমতো কিছু দেখতেও পাইনি।’
‘ওখানে হঠাৎ?’
‘শুনেছি এখনো কিছু জমি বিক্রি হচ্ছে। দামেও নাকি সস্তা। তোমাকে তো আর গুলশান-বনানীতে বাড়ি বানিয়ে দিতে পারব না। তাই ওখানে একটু চেষ্টা করে দেখি।’
ফওজিয়া আর কথা বাড়াননি। খুব দ্রুত সুতির একটা শাড়ি জড়ালেন শরীরে।
লাল পাড়ের অফ হোয়াইট। ঠোঁটে না লাল না গোলাপি লিপস্টিক দিলেন। কপালে কমলা রঙের বড় একটা গোল টিপ। হাত দুটো ভর্তি করলেন সাতরঙা কিছু চুড়িতে। তারপর হাতব্যাগটা বগলের নিচে চালান করে দিয়ে, নিচে নামার জন্য দুজন ঢুকে গেলেন লিফটের ভেতরে। ফওজিয়া খেয়াল করলেন, তার স্বামীর গা থেকে খুব সুন্দর একটা গন্ধ আসছে। এই পারফিউমটা আবার কবে কেনা হলো, মনে মনে ভাবলেন ফওজিয়া। কিন্তু এ নিয়ে কিছু বললেন না। বরং মাথাটা উঁচু করে, মইনের মুখের দিকে তাকিয়ে, খুব মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘ইউ আর সো হ্যান্ডসাম মাই ম্যান।’
ডিসেম্বরের বিকেলের বাতাসে, ব্যস্ত শহরে কচ্ছপগতির যানবাহনের ফাঁকফোকরের ভেতর দিয়ে, গাড়ি চালাতে চালাতে মইন আলী ভাবছিলেন, যা কিছু করার এখনই করতে হবে। তিনি এখন যে পজিশনে আছেন, তার নিজের জন্য কিছু করার এটাই সবচেয়ে মোক্ষম সময়। এখন দলের সিটি কমিটির নেতা। গত বছর সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছেন। তার কানেকশনও ভালো। দলের ওপরের মহলে এবং সরকারের ভেতরে তার অবাধ যাতায়াত। বন্ধুরাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন বাহিনীতে। তার ক্ষমতার হাতও এতখানি দীর্ঘ যে কেউ কিছু চাইলে সেটা তিনি মোটামুটি করে দিতে পারেন। সে কারণে তার নিজের চাওয়া-পাওয়ারও একটা দাম আছে অন্যদের কাছে। পরে কী হয় কে জানে, তাই এখন ঘুমিয়ে থাকলে চলবে না। তিনি জানেন, ঘুমন্ত শৃগাল কখনো শিকার ধরতে পারে না।
তারা চলে এসেছেন বেশ দূরে। শহরের বাইরে হলেও এই এলাকায় সম্প্রতি কতগুলো দেশি রেস্তোরাঁ খুলেছে। দেখতে আহামরি কিছু নয়, খুব সাধারণ। লোকে বলে বাংলা হোটেল। বাঁশ দিয়ে তৈরি। চারপাশটা খোলা। কোনো দেয়াল নেই। রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে মাথার ওপরে শুধু টিনের ছাদ। ভেতরে কাঠের টেবিল পাতা। সারি সারি। অতিথিরা বসেন বেঞ্চিতে। টেবিলের চারপাশ দিয়ে আড়াআড়ি করে রাখা লম্বা লম্বা টুল। বাঁশের।
মইন তার কয়েকজন সহকর্মীর কাছে শুনেছেন, দেখতে ভাঙাচোরা হলেও এসব রেস্তোরাঁর খাবার খুবই সুস্বাদু। কারণ, এখানে লাকড়ি দিয়ে রান্না হয় মাটির চুলায়। প্রায় সব ধরনের ভর্তা, ভাজি, মাছ ও সবজির তরকারি পাওয়া যায়। তরতাজা আর ফরমালিনের অভিশাপ থেকে মুক্ত এসব খাবার।
মইন আলীর ইচ্ছে আজ এখানেই ডিনার শেষে বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু কথাটা এখনো বলা হয়নি ফওজিয়াকে। গাড়িটা রাস্তার এক পাশে, হাইওয়ে থেকে যেখানে একটা কাঁচা রাস্তা একটু নিচু হয়ে হঠাৎ করে জমির দিকে কাত হয়ে নেমে গেছে, সেখানে পার্ক করে তারা দুজনে একটু হাঁটাহাঁটি করলেন। এ রকম খোলা জায়গায় বহুদিন আসেননি ফওজিয়া। মৃদুমন্দ বাতাসে তার শাড়ির আঁচল উড়তে লাগল। সেই সঙ্গে কিছুটা চঞ্চল হলো তার চিত্তও। প্রকৃতির কারণে তার মনের ভেতরে যে এ রকম একটা শিহরণ তৈরি হতে পারে, সেটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি।
সোজা হাঁটতে হাঁটতে আরও পশ্চিম দিকে চলে গেলেন তারা। দেখলেন, ভেতরের দিকে শুধু প্লটের পর প্লট। কোথাও সীমানা দেওয়া, কোথাও সীমানা ছাড়া। কোথাও কোমরসমান ইটের দেয়াল, আবার কোথাও সীমানা থাকলেও সেটা চাপা পড়ে গেছে লম্বা লম্বা ঘাসের আড়ালে। লাল সুরকির রাস্তা ধরেই এগোতে লাগলেন ওঁরা। দুপাশে কোথাও পড়ল ছোট ডোবা, তার মধ্যে টলটল করছে পরিষ্কার পানি, কোথাও কোনো এক প্লটের গর্বিত মালিক বালুর মধ্যেই শখ করে লাগিয়েছে পেয়ারাগাছ। পাতাগুলো হলুদ হয়ে মরে যাচ্ছে।
দূরের একটা পাইলনকে টার্গেট করে এগিয়ে গেলেন দুজন। কিছুক্ষণ পর সাইকেল নিয়ে ছুটে এল রুগ্ণ এক তরুণ। সে ভেবেছিল, ওরাও হয়তো কোনো একটা প্লটের মালিক। জানতে চাইল, ওরা জমিতে বালু ফেলবেন কি না। মইন তখন তার কাছে কিছু খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করলেন। বিক্রির জন্য কোথায় কোথায় এখনো জমি আছে, কতটুকু জমি, ঝামেলামুক্ত কি না, মালিক কোথায় থাকেন, আরও জানতে চাইলেন ওসব জমি এখন কত করে বিঘা।
হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় এসে থামলেন তারা। অবশ্য সামনে এগোনোর আর কোনো সুযোগও নেই। এরপর বিশাল একটি বিল, যেটা ওপাশে নদীর সঙ্গে মিশেছে। বিলের ভেতরে একটা খালি নৌকা। আর এক পাশে জাল ফেলে বসে আছেন একজন বৃদ্ধ জেলে।
বছর তিনেক আগে, ঠিক মনে নেই কোন মাসে, এই এলাকায় একবার এসেছিলেন মইন আলী। ঘটনাক্রমে। এখানে আসার কোনো পরিকল্পনাই তার ছিল না। পুলিশই অনেকটা জোরাজুরি করে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল তাকে। এখানকারই কোনো একটা জায়গায় হবে, একেবারে ঠিক এখানে না হলেও হবে আশপাশের কোথাও, মধ্যরাতের পর এক প্লাটুন বাহিনী নিয়ে দুটো জিপ গাড়িতে করে তারা এসেছিল ঝড়ের গতিতে।
কিন্তু আজ তার কিছুই চিনতে পারছেন না মইন আলী। চেনার কথাও না। ওই রাতে আকাশে চাঁদও ছিল না। চারপাশজুড়ে ছিল শুধু অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার। তার ভেতরে ছিল আগুনের ফুলকির মতো সহস্র জোনাকির আলো। মইনের এখনো মনে পড়ে, খুব ঘন ছিল ওই রাত। দুধের সরের মতো জমাট অন্ধকার চিরে জিপের হেডলাইট ও টর্চের আলোতে মইন কত দূর কী দেখেছিলেন, সেসব তার আর মনে নেই। কিন্তু ওই রাতে বুকে কাঁপন ধরানো ঝিঁঝি পোকার বীভৎস সব ডাক তার কানে এখনো গেঁথে আছে।
ফওজিয়া তখন একটু দূরে। ডুবে আছেন নিজের আপন জগতে। এই ভুবন তার নিজস্ব। মইনেরও প্রবেশাধিকার নেই সেখানে। গুনগুন করে গান গাইছেন। একসময় গুটি গুটি পায়ে হারিয়ে গেলেন কাশফুলের ঘন ঝোপের ভেতরে। বেরিয়ে এলেন কিছুক্ষণ পর। মইন তখন পকেট থেকে তার ফোনটা বের করলেন। দূর থেকে কয়েকটা ছবি তুললেন স্ত্রীর। তারপর সদ্য তোলা ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো, বিয়ের দিন যে রকম দেখেছিলেন, ঠিক সে রকমই আছে জয়া (ফওজিয়া), কিন্তু প্রায়ই তার মনে হয়, ফওজিয়া আসলে অনেকখানি বদলে গেছেন!
এতক্ষণে চারপাশের সোনারোদ মরে গেছে। মইন আলী দেখলেন, একটু আগেও যে সূর্যটা তালগাছগুলোর মাথার ওপরে ঝুলেছিল, সেটা খুব দ্রুত নিচের দিকে নামতে লাগল। যেন এখনই ওটা বিলের পানিতে টুপ করে পড়ে যাবে। আজ ওর এত তাড়া কিসের? মইনের মনে পড়ল, লিফটে নামার সময় দেখেছেন, ফওজিয়াও আজ এ রকমই একটা টিপ পরেছেন কপালে।
ওরা যখন হাইওয়েতে উঠে এল, সূর্যটা তখন বিলের পানিতে তার সমস্ত রং গলিয়ে ডুবে গেছে গ্রামের ওপাশে। ধীরে ধীরে চারপাশে ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার। মইন গাড়ির ভেতরে ঢুকে ফওজিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে হেডলাইট অন করলেন। বললেন, ‘এখানে ডিনার করলে কেমন হয়?’
‘এইখানে!’ ভ্রু কুঁচকালেন ফওজিয়া।
হুম্, অসুবিধা কী জয়া? একদিন খেয়েই দেখো না!
পেট খারাপ করবে না তো আবার?
দুনিয়ার মানুষ খাচ্ছে না বুঝি! মইন তার স্ত্রীকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন।
কিন্তু এখনো তো ডিনারের সময় হয়নি।
গাড়ির ড্যাশবোর্ডে সময় দেখলেন মইন আলী। সাতটার মতো বাজে। ‘অসুবিধা নেই। চারপাশে একটা চক্কর দিলে সময় কেটে যাবে, জায়গাটাও দেখা হবে,’ এটুকু বলে হুশ করে হাইওয়েতে ওঠে এলেন মইন।
পাশাপাশি কয়েকটা হোটেল দেখে গাড়ি থামালেন মইন আলী। তার সামনে আরও কিছু গাড়ি এলোপাতাড়ি দাঁড় করানো। একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে প্রথমে চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখলেন তিনি। খুব বেশি ভিড় নেই আজ। দেখলেন দুটো পরিবার পাশাপাশি বসে গল্প করতে করতে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছে।
রেস্তোরাঁর ভেতরে কিছুক্ষণ পায়চারি করে ফওজিয়া কোনার একটি টেবিলে গিয়ে বসেছেন। কখনো কোথাও গেলে তিনি প্রথমে এ রকম একটা নিরিবিলি জায়গা খুঁজে বের করবেন, এটাই যেন ধরাবাঁধা নিয়ম। বাইরে গেলেও লোকজন এড়িয়ে চলবেন ফওজিয়া, কথা বলবেন কম। তার কানের পাশে মানুষের উচ্চকণ্ঠ, চোখের সামনে পরিচিত-অপরিচিত লোকজনের হাঁটাচলা তাকে খুব অস্থির করে তোলে। মইন যখন এসব নিয়ে তার স্ত্রীকে কোনো প্রশ্ন করেন, ফওজিয়ার সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘ভাই, এটা আমার অসুখ। তো আমি কী করব বলো?’
ফওজিয়া আলী তার ছোট্ট পরিবার নিয়ে—পরিবার বলতে শুধু তার স্বামী আর একজন গৃহপরিচারিকা রাসেলের মা—নিজের মতো করে গুটিয়ে থাকতে চান। কিন্তু আগে তিনি এ রকম ছিলেন না। বিয়ের পর মইন দেখেছেন, তার জয়া খুব হাসিখুশি আর প্রাণোচ্ছল ছিল। সব সময় শান্ত-স্নিগ্ধ আর চোখজুড়ানো একটা হাসি লেগে থাকত মুখে। তাকে তো বটেই, বাড়ির সবাইকে মাতিয়ে রাখত সে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স-মাস্টার্স করা ফওজিয়া লেখাপড়া শেষ করে একটা ইংরেজি দৈনিকে চাকরিও নিয়েছিলেন। মফস্বল পাতার এডিটর হিসেবে। নিজের কাজ নিয়ে খুব গর্বও করতেন তিনি। বাড়িতে ফিরে মইনের সঙ্গে সারাক্ষণ বকবক করতেন। এ জন্য মইন কখনো কখনো, মজা করে, তার স্ত্রীকে ‘বিবিসি’ বলেও ডাকতেন। ফওজিয়া তার স্বামীকে বলতেন আজ কোথায় কী কী ঘটেছে, কোন জেলার কোন রিপোর্টার কী খবর পাঠিয়েছে। তারপর মোহাম্মদপুরে, ওরা যেখানে থাকে, তার কাছেই নাকি একজন তরুণ পুলিশের সঙ্গে ক্রসফায়ারে মারা গেছে।
‘আচ্ছা, মইন, তুমি কি কাল রাতে গোলাগুলির শব্দ শুনেছ?’
ওরা তখন খাবার টেবিলে। একটু আগে ফওজিয়া অফিস থেকে ফিরেছেন। কিন্তু অন্যান্য দিনের চেয়ে তাকে একটু বেশি অস্থির লাগছিল। মইনের প্লেটে ভাত তুলে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘কোথায়?’ জানতে চাইলেন মইন।
‘বেড়িবাঁধের ওপারে। রাত দুটা-তিনটা হবে। তখন নাকি সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পুলিশের প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়েছে।’
‘হতে পারে জয়া। সন্ত্রাসীরা আজকাল খুব বেশি ঝামেলা করছে। লোকজনের ঘুম হারাম হওয়ার মতো অবস্থা। ও রকম দু-একটা মরলে তবে শান্তি।’
‘পুলিশের প্রেস রিলিজেও সে রকম লিখেছে। কিন্তু আমাদের রিপোর্টার বলছে, নিহত ছেলেটি বিরোধী দলের। হরতাল হলে ও-ই নাকি রাস্তায় থাকত। তোমাদের দলের এক নেতারও নাকি হাত আছে এই ক্রসফায়ারের পেছনে।’
‘কী যে বলো তুমি, এ-ও কি কখনো হয়, আমরা বললাম আর পুলিশ ঠুস করে মেরে ফেলবে?’
‘আমাদের রিপোর্টার ইনভেস্টিগেট করছে।’
‘করুক, তখন দেখবে যে কেমন সত্যটা বেরিয়ে আসে। কিন্তু এখন তো ঘুমাতে দেবে, নাকি?’
এ রকম আরও কত ধরনের খবর দেন ফওজিয়া তার স্বামীকে। বেশির ভাগ খবরই তিনি স্বামীর সঙ্গে শেয়ার করেন ডিনারের টেবিলে।
এ রকম করেই চলছিল দিন। কিন্তু কয়েক বছর পর হঠাৎ করে কী যেন হলো ফওজিয়ার, একদিন হুট চাকরি ছেড়ে দিলেন। মইন জানতেন না সেটা। এ বিষয়ে তাকে কিছু বলেনওনি ফওজিয়া। মইন দেখলেন, স্ত্রী টানা কয়েক রাত তাকে কোনো খবর দিচ্ছেন না। খাবারের টেবিলে বসে, আর তিনিও তেমন কিছু জানতে চান না। চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে যান বিছানায়। মইনের প্লেটের দিকেও তার চোখ নেই। একদিন, সম্ভবত বুধবার হবে, সেদিন রাতে খুব বিচ্ছিরি একটা গরম পড়েছিল, বিদেশি চ্যানেলে একটা মুভি দেখার পর মইন বিছানায় তার স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হতে হতে জানতে চাইলেন: ‘খবর কী বলো?’
‘তেমন বড় কিছু নেই,’ ফওজিয়ার নির্লিপ্ত উত্তর।
‘কী বলো! বিবিসির কাছে কোনো খবর নেই!’ স্ত্রীকে একটু চাঙা করতে চাইলেন মইন।
‘বিরক্ত করো না মইন, ঘুমাতে দাও তো প্লিজ।’ পাশ ফিরে স্বামীর দিকে পিঠ দিলেন ফওজিয়া।
মইনের তখন আর খবরের প্রতি অতটা আগ্রহ ছিল না, যতটা আগ্রহ ছিল ফওজিয়ার শরীরের জন্য। তৃপ্ত মইন যখন এক পাশে গড়িয়ে ছাদের দিকে মুখ দিয়ে শুয়ে পড়েন, সুখের রেশ তখনো তার শরীরে নদীর স্রোতের মতো পা থেকে মাথা পর্যন্ত কলকল করে বয়ে চলেছে, শরীর ঘেমে গেছে প্রচণ্ড গরমে এবং উত্তেজনায়। এসিটার দিকে তাকালেন তিনি। হিশ হিশ করে একটা শব্দ হচ্ছে। ভাবলেন, তাপমাত্রা আরও একটু কমিয়ে দিলে ভালো হতো। কিন্তু সমস্যা ফওজিয়াকে নিয়ে। এসির বাতাস তিনি মোটেও সহ্য করতে পারেন না। গরমেও কাঁথা লাগে তার। ফওজিয়ার নগ্ন ঊরুর ওপর পা তুলে দিয়ে মইন টের পেলেন, তার স্ত্রীর শরীর ইতিমধ্যেই ঠান্ডা হতে শুরু করেছে।
জংলাছাপ চাদরে পিঠ দিয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকালেন মইন। মশারির নেটের জন্য স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তিনি দেখলেন মশারির গায়ে ফ্যানের ব্লেডগুলো এমন একটা ছায়া তৈরি করেছে যে মনে হচ্ছে একটা মৃতদেহ পড়ে আছে রাস্তার কিনারে। ওই রাতেও ঘুমাতে পারলেন না তিনি।
একদিন দুপুরে ফওজিয়ার কাগজের সম্পাদকের একটা ফোন এল। খচখচ করে উঠল মইনের মন। ওপাশ থেকে সম্পাদক সাহেব তখন নিজের পরিচয় দিলেন: ‘কী সেক্রেটারি সাহেব, অনেক দিন দেখা হয় না আপনার সঙ্গে।’
জবাবে মইন বললেন, ‘জি। কী করতে পারি আপনার জন্য বলুন।’
‘কিছু করতে হবে না আলী ভাই। আপাতত বলেন তো দেখি ফওজিয়ার কী হয়েছে?’
‘কেন সামাদ ভাই?’
‘ও চাকরিটা হুট করে ছেড়ে দিল কেন?’ আকাশ থেকে পড়লেন মইন। এই প্রশ্নটা তার কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু সামলে নিলেন নিজেকে। এই খবরটা যে তার জানা ছিল না, সেটা তিনি সম্পাদক সাহেবকে বুঝতে দিতে চান না।
‘ফওজিয়া খুব ব্রাইট একটা মেয়ে। খুউব ভালো করছিল। মফস্বলের পাতার চেহারাটাই ও বদলে দিয়েছে। আমার সব জেলার করেসপনডেন্টরা ওকে খুব পছন্দ করে।’
চুপ করে রইলেন মইন। স্ত্রীর প্রশংসা শুনতে তার ভালোই লাগছিল।
‘আমি ভাবছিলাম ওকে ফ্রন্ট পেজে নিয়ে আসব। আর তখনই ও রিজাইন করে ফেলল!’ কথার মাঝখানে বাধা না দিয়ে মইন তখনো চুপ করে রইলেন। সম্পাদককে আরও কিছু বলার সুযোগ দিলেন তিনি। ‘এ জন্যই আপনাকে ফোন দিলাম। দেখেন তো বুঝিয়ে-শুনিয়ে যদি ওকে ফেরত পাঠাতে পারেন।’
‘অফিসে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?’ জানতে চান মইন।
‘সে রকম হলে আমাকে ও বলুক। আমি ব্যবস্থা নেব।’ সম্পাদকের উত্তর।
‘দেখি সামাদ ভাই, আমি কী করতে পারি। জানাব আপনাকে।’
এটুকু বলে ফোন রেখে দিলেন মইন আলী। রাতে বাড়িতে ফিরে প্রথমেই কিছু বললেন না স্ত্রীকে। খাবারের সময়ও না। পরে সোফায় ফওজিয়ার কোলের ওপর মাথা রেখে রিমোট টিপতে টিপতে কথাটা পাড়লেন তিনি। ‘জয়া, তোমার কি কোনো সমস্যা হয়েছে?’
‘কিসের সমস্যা!’
‘আমাকে বলতে পারো, আমি তো তোমাকে সাহায্য করতে পারি। নাকি?’
‘কই, আমার তো কোনো সমস্যা হয়নি।’ একটু বিরক্ত ফওজিয়া।
‘তুমি নাকি কাগজের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছ?’
ফওজিয়া আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন যে তাকে এ রকম একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে এখন। আর সে জন্য মনে মনে একটা উত্তরও গুছিয়ে রেখেছিলেন। ‘হুম্, আর ভালো লাগছে না।’
‘আমাকে বলোনি কেন?’
‘বলতাম। বলার সময় তো শেষ হয় যায়নি।’
‘কেন ছাড়লে? অফিসে কি কিছু হয়েছে?’
‘না না, ও রকম কিছু না। আমি ভেবে দেখলাম আমার নিজেকে কিছু সময় দিতে হবে। তোমাকেও সময় দেওয়া দরকার। আমাদের বিয়ের সাত-আট বছর হয়ে গেল। এখন তো একটা সন্তান নেওয়া উচিত, তাই না?’
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইলেন। ফওজিয়া বললেন, ‘এখন না হলে আর কবে হবে।’
‘সময় তো আর শেষ হয়ে যায়নি,’ নির্লিপ্ত কণ্ঠে ফওজিয়ার কথাটা ফিরিয়ে দিলেন তিনি।
মইন আলী তার স্ত্রী ফওজিয়ার সঙ্গে তাদের বাচ্চা না হওয়া নিয়ে খুব বেশি কথা বলেননি কখনো। একেবারেই যে বলেননি তা নয়, বলেছেন, কিন্তু তাতে কখনো এ রকম অভিযোগের সুর ছিল না, বরং তাতে ছিল একে অপরের প্রতি মায়া ও ভালোবাসার প্রকাশ। যদিও এই শূন্যতা একটা গোপন কাঁটার মতোই বিঁধে ছিল তার মনের নরম ভূমিতে। এখন সেই রক্তাক্ত জায়গাটা ফওজিয়া হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলেন সরাসরি।
মইন জানেন যে এই দীর্ঘশ্বাস শুধু তার একার নয়। এই কষ্টটা ফওজিয়ারও সমান। কিন্তু এর জন্য কে দায়ী, সেটা তো তারা কেউই জানেন না। এ রকম কোনো টেস্টও করা হয়নি এখনো। ডাক্তারের কাছে যাব যাব করেও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। মইনের মা ও বোনেরা কয়েকবার প্রশ্নটা তুলেছিলেন, কিন্তু মইন সেটাকে বাড়তে দেননি। শুধু ভেবে রেখেছেন দুজনেই কোনো এক সময়ে সিঙ্গাপুরে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আসবেন।
ফওজিয়ার মুখে বাচ্চা নেওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথা শোনার পর স্ত্রীর চাকরি ছাড়া নিয়ে আর কিছু বলেননি মইন। তিনি জানেন, মেঘের ভেতরে বৃষ্টি জমে থাকার মতো ওই আকাঙ্ক্ষার পেছনেও লুকিয়ে আছে একটা গভীর হতাশা। কিন্তু ফওজিয়া সেই হতাশার কথা তার কাছে গোপন রেখেছেন, যেমনটা রেখেছেন তিনি নিজেও। এক মশারির ভেতরে, এক ফ্যানের নিচে, এক চাদরের উপরে তারা পাশাপাশি থাকেন, কিন্তু তারা কেউই একে অপরের এই দীর্ঘশ্বাস শুনতে পান না। যদিও তারা দুজনেই ভালো করে জানেন যে তাদের মনের গর্তের ভেতরে এ রকম একটা সাপ পেঁচিয়ে আছে। কিন্তু তারা এই সাপকে কখনো খোঁচা দেন না, এই ভয়ে, যদি সে ফোঁস করে জেগে ওঠে।
মইন আলীর নিজের মনটাও তখন একটু খারাপ হয়ে গেল। কী হবে যদি দেখেন যে আসলে তার নিজের শুক্রাণুই এই সবকিছুর মূল কারণ! আর যদি ফওজিয়ার সমস্যাও হয়, তখনই-বা কী করবেন তিনি। তার বুকের ভেতরে এ রকম কিছু প্রশ্ন নিজের অজান্তেই লাউয়ের ডগার মতো লকলক করে বাড়তে থাকে। ফওজিয়ার বুকেও কি এ রকম প্রশ্ন জমে আছে? তারা দুজনেই তো জানেন, বুকের ভেতরে বেড়ে ওঠা এসব গোপন প্রশ্ন হচ্ছে আগাছার মতো। সময়মতো উপড়ে না ফেললে ওরা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়বে যে শেষ পর্যন্ত তাদের নিশ্বাসও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
মইন আলী দেখেছেন, ফওজিয়া আজকাল একা একা থাকতেই পছন্দ করেন বেশি। আজ কত বছর হয়ে গেল ওদের বিয়ে হয়েছে, কিন্তু মাঝেসাঝে মইনেরই ওকে চিনতে অসুবিধা হয়। আগে যে মানুষটা ঘরভর্তি মানুষ নিয়ে হইহুল্লোড়ে মেতে থাকত, সে কিনা এখন ঘরের ছিটকিনি লাগিয়ে ওপাশের বারান্দায় চুপচাপ বসে দূরের বাড়িঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এ জন্য মইন একদিন তার স্ত্রীকে রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘জয়া, তুমি তো একটা চড়ুই পাখির মতো চঞ্চল ছিলে একসময়, কিন্তু হঠাৎ এমন শামুক হয়ে গেলে কেন?’ এই কথায় ফওজিয়া রাগ করেন না, আবার খুশিও হন না। ফওজিয়ার হুট করে এই জীবন বেছে নেওয়ার পেছনে যে কারণ, সেটা এই পৃথিবীতে একমাত্র তিনিই জানেন।
খোঁটা দিয়েও নিজের স্ত্রীকে যখন উত্তেজিত করতে পারেন না, তখন মইন আলী নিজেও একবার ভাবেন যে তার জীবনটাও যদি এ রকম শামুকের মতো হতো, তাহলে খুব একটা মন্দ হতো না। ইদানীং তার নিজেরও মনে হয় যে জীবনটা অনেক বেশি জটিল আর ঘোলাটে হয়ে গেছে। কীভাবে কীভাবে যে এমন হয়ে গেল, সেটা তিনি নিজেও বুঝতে পারেন না।
একটার পর একটা ঘটনা তাকে আজ এত দূর নিয়ে এসেছে। তার জীবন শুরুতে এ রকম ছিল না। হুট করেই কোনো একটা ঘটনা থেকে শুরু হয়েছে তার এই নতুন জীবন। শিকলের একটা রিং যেমন আরেকটা রিংকে পেঁচিয়ে নিজে টিকে থাকে, তেমনি তার জীবনেরও একটা ঘটনা, আরেকটা ঘটনাকে আঁকড়ে ধরে তাকে টিকিয়ে রেখেছে। এই জট খোলার এখন আর কোনো উপায় দেখছেন না তিনি। মইন আলীর কখনো কখনো মনে হয় শিকল ভেঙে একদিন ঠিক ঠিক এই জীবন থেকে নিঃশব্দে পালিয়ে যাবেন তিনি। কিন্তু ভয় পান। সে এক ভয়ানক ভয়।
এই ভয় বর্ণনা করার ভাষা তার নেই। শুধু তা-ই নয়, এই ভয়ের কথা শেয়ার করারও কোনো মানুষ নেই তার জীবনে। এমনকি ফওজিয়াও না। কোনো কোনো রাতে ভয়ের চোটে ঘুম ভেঙে যায় মইনের। অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন তিনি। একদিন দেখলেন একদল লোক তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের ভেতরে। তার হাত দুটো পিঠমোড়া করে বাঁধা। তাকে বলা হলো দৌড়াতে কিন্তু তিনি দৌড়াতে পারছেন না। তার পা ভেঙে যাচ্ছে। আরেক রাতে দেখলেন তার মৃতদেহ পড়ে আছে জলমগ্ন ধানখেতের ভেতরে। তখন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে শিয়ালের ডাক। ওই ডাকে স্বপ্ন ভেঙে গেলে বিছানায় উঠে বসে থাকেন তিনি। দেয়ালের এক পাশে জানালার ওপরে হিশ হিশ করে এসি চলছে, কিন্তু তারপরও ঘামে ভিজে যায় তার শরীর। ফওজিয়াকে ডেকে তোলারও সাহস পান না। ডেকে কী বলবেন তাকে? কখনো কখনো এমনও রাত গেছে যে মইন আলী বিছানা ছেড়ে ঘর থেকে উঠে গিয়ে বসে থেকেছেন সিটিং রুমের সোফায়, কিংবা বেডরুম লাগোয়া ছোট্ট বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। রাতের আকাশে দেখেছেন ভেসে যাওয়া কালো মেঘ, তার ভেতরেও ওত পেতে ছিল ভয়। হঠাৎ একখণ্ড মেঘকে তার মনে হলো চিত হয়ে পড়ে থাকা একটা লাশ, সেখানে চাঁদের আলো এমনভাবে পড়েছে যেন গড়িয়ে পড়ছে রক্তের স্রোত। ইঁদুরের মতো ছুটে পালিয়ে এলেন ঘরের ভেতরে। আরও একটা রাত নির্ঘুম কাটল মইন আলীর।
রেস্তোরাঁর রেডিওতে তখন কী একটা অনুষ্ঠান চলছে। শোনো, স্বামীকে ডাকেন ফওজিয়া। বললেন,‘খুব বেশি কিছু অর্ডার দিয়ো না।’
‘কী খেতে চাও?’
‘এনিথিং, তুমি পছন্দমতো বলে দাও।’
এখানে মইন কয়েক বিঘা জমি কেনার পরিকল্পনা করছেন। কিছু জায়গা দেখেও রেখেছেন। মনে মনে সিদ্ধান্তও নিয়ে নিয়েছেন কেনার। কিন্তু ফওজিয়াকে দেখানো তো দূরের কথা, এ নিয়ে তাকে কিছু বলাও হয়নি। মইন ভেবে রেখেছেন, আজ এখানে বসে, খেতে খেতে জমি কেনার পরিকল্পনার কথাটা তিনি তার স্ত্রীকে জানাবেন।
শিমভর্তা, ডালভর্তা, লাউ দিয়ে মাগুর মাছের ঝোলের মতো একটা তরকারি, দুই বাটি চিকেন আর দুই প্লেট ভাত দেওয়ার কথা বললেন মইন আলী। দেখলেন কিছু মাছি বড় বড় খাবারের ডালাগুলোর ওপর ভনভন করে উড়ছে। দেখে একটু ইতস্তত করলেন তিনি। একটা ছোট ছেলে বসেছিল খাবারগুলোর ওপাশে। সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালেন মইন। বললেন, ‘এই, এগুলো কবের তরকারি?’
‘ছার, আইজকাই রানছে’, ছেলেটি তড়িঘড়ি করে উত্তর দিল।
‘মাছি ক্যান এত? খাবার ঢাইকা রাখতে পারস না?’
ছেলেটি মাথা নিচু করে বসে রইল। কোনো উত্তর দেওয়ার সাহস নেই ওর। দূরে বড় বড় পাত্রে খাবার গোছগাছ করছিল মধ্যবয়সী এক লোক, দোকানের ম্যানেজার।
মইন আলী কার কাছ থেকে জমি নেবেন, সেটা মোটামুটি ঠিকই হয়ে আছে। তারই এক বন্ধু, যে এখন পুলিশে আছে, ওই লোকের খোঁজ দিয়েছে তাকে। দুই বিঘার বেশি হবে। কথা মোটামুটি ফাইনাল। জমির মালিক কয়েক মাস ধরে আছে জেলখানায়। প্রথমে তার নামে কয়েকটা কেস দেওয়া হয়েছে। তারপর হয়েছে আপসরফা। এখন শুধু জামিনের জন্য অপেক্ষা। ওটা ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলেই জমির রেজিস্ট্রেশন।
খেতে খেতে মইন তার স্ত্রীকে জমির কথাটা বললেন। ফওজিয়া প্রথমে একটু আপত্তি তুলেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন দুই বিঘা জমি কেনার টাকা তিনি পাবেন কোথায়। ঢাকা শহর এখন যত দ্রুতগতিতে বাড়ছে, আর জমির যে চাহিদা তাতে এখনকার দুই বিঘার দাম কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ‘তুমি ওসব নিয়ে ভেবো না জয়া। ম্যানেজ হয়ে যাবে,’ এইটুকু বলে মাছের একটা কাঁটা দাঁত দিয়ে চেপে মইন তাকালেন ফওজিয়ার চোখের দিকে। কিন্তু পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে নিলেন। পারলেন না তাকিয়ে থাকতে। দেখলেন ফওজিয়ার চোখে অবিশ্বাস স্পষ্ট।
মইন আলী আর স্ত্রীকে সবকিছু বলেননি। কারণ, ঘটনাপ্রবাহে জীবনের যে পঙ্কিলতায় তিনি ডুবে গেছেন, সেটা তিনি নিজের কাছেও গোপন রাখতে চান। তবে তিনি এটাও জানেন, এখন যে পদে তিনি আছেন, সেটা তার জীবনে আলাদিনের চেরাগের মতো। এই চেরাগ সব সময় পাওয়া যায় না। ফলে যা ঘষা দেওয়ার, সেটা দিতে হবে এখনই। পরে দিন-রাত চেরাগ ঘষলেও এই দৈত্য আর কখনো আসবে না।
ফওজিয়া জানেন না যে এই দৈত্যই এর মধ্যে ঢাকায় তাদের দুটো ফ্ল্যাট এনে দিয়েছে। সেগুনবাগিচার অ্যাপার্টমেন্টের কথা শুধু ফওজিয়া জানেন। তাকে বলতে হয়েছিল কারণ দৈত্যটা মইনকে বলেছে ওই ফ্ল্যাট তার স্ত্রীর নামে রেজিস্ট্রেশন করাতে। দৈত্যটা গাজীপুরেও তাকে দুই একর জমি জোগাড় করে দিয়েছে, সেটাও জানেন না তিনি। আর এখন তো তার স্বামীর হাতে এনে দিয়েছে এই কেসটাও। তার জের ধরে যে জমিটা একেবারে হাতের নাগালের কাছে, তার কথা আজই মইন আলী একটু একটু করে তার স্ত্রীকে বলতে শুরু করেছেন।
‘জয়া,’ খেতে খেতে মুখ তুলে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মইন বলতে লাগলেন, ‘এখানে যে জমিটা হবে সেটা তোমার নামেই করে দিই, কী বলো?’ স্ত্রীর উত্তরের অপেক্ষা না করে তিনি বলতে লাগলেন, ‘আমার নামে হলে যদি পরে ঝামেলা হয়। যদি এটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে। শুরু থেকেই সবকিছু গুছিয়ে রাখা ভালো।’
এবারও কিছু বললেন না ফওজিয়া। বরং বলতে থাকলেন মইন, ‘কয়েক মাসের মধ্যেই সব ফাইনাল হয়ে যাবে। তোমাকে বেশি কিছু করতে হবে না। একটা কাগজে সই করতে হবে শুধু। আর একদিন রেজিস্ট্রেশনের জন্য তোমাকে ভূমি অফিসে নিয়ে যাব, ব্যস, এতটুকুই।’
কথা বলতে বলতে মইন আলী দেখলেন, ফওজিয়ার বাঁ পাশে একটা লোক এসে বসেছে। বয়সে তরুণ। গায়ের জামাকাপড়ও খুব একটা পরিষ্কার নয়। রুক্ষ মুখ। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মইন একবার লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলেন। কিন্তু কেমন খচখচ করে উঠল তার মনের ভেতরে। লোকটাকে চেনা চেনা মনে হলো তার। কিন্তু মনে করতে পারলেন না, কে এই তরুণ। এ জন্য তার একটু অস্বস্তি হলো। লোকটার ওপর থেকে মনোযোগ অন্যত্র সরিয়ে ফেলতে চাইলেন তিনি। ফওজিয়াই তখন তার সাহায্যে এগিয়ে এলেন, ‘এত কিছু দিয়ে তুমি কী করবে মইন?’
‘কী যে বলো না জয়া, এত কিছু কই দেখলা তুমি?’
‘এই যে ফ্ল্যাট, জমিজমা এসব দিয়ে কী করবা?’
‘কেন বলো তো, তুমি মনে হয় অনেক বড়লোক হয়ে গেছ? আমি ভাই গরিব মানুষ। অনেক সংগ্রাম করে এখানে এসেছি। আমাদের পরিবারের কথা তুমি জানো। তোমাকে বলেছি কেমন ছিল আমার ছোটবেলা। এখন যদি একটা কিছু করতে চাই, তাহলে কি সেটা দোষের?’
‘আমি তো তোমাকে কোনো দোষ দিইনি মইন। শুধু বলেছি, এত কিছু দিয়ে করবেটা কী! আমাদের তো আর কেউ নেই। তুমি আমি ছাড়া।’
ধক করে উঠল মইন আলীর বুকের ভেতরে। মনে হলো তার স্ত্রী তাকে খোঁচা দিচ্ছে। কেউ নেই মানে তো সন্তান না হওয়া। ফওজিয়া বুঝি পরোক্ষভাবে বলতে চাইছে তাকে সন্তান দেওয়ার কোনো ক্ষমতা তার নেই। কিন্তু কীভাবে? সেটা তো তারা জানেন না এখনো। আর এখন কেউ নেই মানে তো এই নয় যে ভবিষ্যতেও তাদের কেউ হবে না। জীবন তো শেষ হয়ে যায়নি মোটেও।
এর কয়েক দিন পর, তারা বসেছিলেন বারান্দায়, পাশাপাশি দুটো বেতের চেয়ারে। খুব ভেঙে পড়েছিলেন ফওজিয়া। কাঁদতে কাঁদতে ফওজিয়া মইনকে বলেছিলেন, ‘চলো, আমরা এখান থেকে চলে যাই। তুমি অন্য কিছু করো মইন।’
‘কেন, এখানে কী অসুবিধা হচ্ছে তোমার, বলো?’
‘জানি না, আমার ভালো লাগছে না। শ্বাস নিতে পারি না।’
‘কী যে ছেলেমানুষি করো তুমি জয়া!’
ফওজিয়া তখন তার স্বামীকে পুরো বিষয়টা খুলে বলার প্রস্তুতি নিলেন। উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার থেকে। এক পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। কয়েক মাস আগে ওখানে একটা টবে লেবুগাছ লাগিয়েছিলেন ফওজিয়া। গাছটা এখন বেশ বড় হয়েছে। ফুল ধরেছে কিছু। তার হালকা একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।
‘মিরপুরের সুমন কোথায় আছে তুমি কি জানো, মইন?’
‘হু ইজ সুমন?’
‘যে ছেলেটা বাড়ি থেকে হঠাৎ গুম হয়ে গেল। ওর মা বলছে, সাদাপোশাকের একদল লোক ওকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু পুলিশ বলছে ওরা কিচ্ছু জানে না।’ ফওজিয়ার গলা এখন ভারী।
‘আমি কীভাবে জানব জয়া? আমি কি তোমাদের মতো সাংবাদিক নাকি?’ খুব দ্রুত উত্তর দিলেন মইন আলী।
‘সাংবাদিকেরা যা জানে না তোমরা পলিটিশিয়ানরা সেটা জানো, মইন।’
‘জয়া, তোমার এসব কথার কোনো মানে বুঝতে পারছি না।’
এরপর তিনি ‘এসব কথার’ অর্থ বোঝাতে পুরো ঘটনা খুলে বললেন তার স্বামীকে। ‘তুমি কি জানো আমি কেন চাকরি ছেড়ে দিয়েছি? জানো না। আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি কারণ যে খবর আমি ছেপেছি, সেটা আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কিন্তু বিশ্বাস না করেও উপায় ছিল না। আমি নিজে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে খোঁজ নিয়েছিলাম। অনেক জায়গা থেকেই তোমার নামটা বলা হয়েছে। আমাদের রিপোর্টার যে খবর দিয়েছে, তাতে আরও কয়েকটা নামের সঙ্গে তোমার নামও ছিল মইন। রাস্তা পরিষ্কার রাখতে তোমরা ওকে সরিয়ে দিয়েছ।’
এটুকু বলে ফওজিয়া আকাশের দিকে তাকালেন। পরিষ্কার নীল আকাশ ছিল একটু আগেও। কিন্তু এখন সেখানে ভিড় করেছে ছাইরঙা কিছু মেঘ। মইন দেখলেন, একটা মেঘ আরেকটা মেঘের ভেতরে এমনভাবে ঢুকে গেছে, মনে হচ্ছে অন্তঃসত্ত্বা এক নারী পরির মতো উড়ে যাচ্ছে আকাশে।
‘মইন, তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও।’
‘কী বলছ তুমি!’
‘আমি যা বলছি, সেটা খুব পরিষ্কার এবং সহজ। ইউ শুড লিভ পলিটিকস।’
‘চাইলেই ছাড়া যায় না জয়া। এটা আমার রক্তের সঙ্গে মিশে আছে।’
‘চেষ্টা করে দেখো, না পারলে চলো আমরা বিদেশে চলে যাই।’
মইন আলী চেয়ার থেকে উঠে এসে ফওজিয়ার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। দুহাতে আঁজলা করে ধরার চেষ্টা করলেন তার মুখ। ফওজিয়া তার ডান হাত দিয়ে একঝটকায় ঠেলে সরিয়ে দিলেন মইনের হাত। ‘তুমি যা শুনেছ সব মিথ্যা জয়া। সব মিথ্যা। বিশ্বাস করো তুমি। প্লিজ, বিশ্বাস করো,’ বলতে বলতে আরও সামনের দিকে এগিয়ে ফওজিয়াকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। ফওজিয়া তখন আছড়ে পড়েছে তার স্বামীর বুকের ওপর। মইন টের পেলেন ফওজিয়ার কান্নার দমকে তার শরীরটাও কাঁপছে। শুনতে পেলেন আকাশে তখন থেমে থেমে গুলি হওয়ার মতো গুড়গুড় করে মেঘ ডাকছে।
রেস্তোরাঁয় ফওজিয়ার পাশে বসা লোকটার দিকে আবারও তাকালেন মইন আলী। ভাবলেন কোথায় দেখেছেন তাকে। ভেবে ভেবে ভেতরটা প্রচণ্ড অস্থির হয়ে গেল তার। মাথায় যখন একটা কিছু ঢোকে, সেটা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত নিস্তার নেই তার। মইন তখন খাওয়ায় মনোযোগ দিতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না। নিজের অজান্তেই বারবার তার চোখ চলে যাচ্ছে ওই তরুণের মুখের ওপর। যতবারই তিনি তার দিকে তাকিয়েছেন ততবারই দেখেছেন যে সে-ও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মইনই চোখ নামিয়ে নিয়েছেন প্রতিবার।
কোথায় দেখেছেন তাকে, কোথায়, কোন জায়গায়, কে এই তরুণ? কার মতো এই এক জোড়া চোখ? এর আগে তো কোনো মানুষ তাকে এভাবে টানেনি কখনো, কিন্তু একটু আগে উড়ে এসে জুড়ে বসা এই লোকটি যেভাবে বারবার তার দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে, মনে হচ্ছে সে-ই তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু সেই চোখের দিকে তাকাতেও অসুবিধা হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে, অচেনা ওই যুবকের চাহনিতে হাজার হাজার তির। আর সেগুলো তীব্রগতিতে ছুটে আসছে তার দিকে।
মইন আলীর মনে পড়ল তিন বছর আগের এক রাতের কথা। একটা ফোন পেয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন তিনি। তাকে খবর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। প্রথমে বলা হয়েছিল, শুধু থানায় গেলেই চলবে। একজন ‘সন্ত্রাসীর’ নাম-পরিচয় নিশ্চিত করেই ফিরে আসবেন তিনি। কিন্তু পরে ঘটনা মোড় নিল অন্যদিকে। তখন কোনো কিছুর ওপরেই নিয়ন্ত্রণ রইল না মইনের। তাকেও যেতে হয়েছিল পুলিশের সঙ্গে। অমাবস্যার রাত ছিল সেদিন। দুটো দলে বের হয়েছিল তারা। দুটো গাড়িতে ছিল তাদের দল। সামনেরটাতে ছিলেন মইন, এসআই জমির এবং আরও তিন–চারজন পুলিশ। একজন তরুণ ছিল তাদের সঙ্গে। নাম: হামিদুল ইসলাম। ওর নামে তেজগাঁও থানায় একটা মার্ডার কেস দেওয়া হয়েছিল প্রথমে। তারপর বহু খোঁজাখুঁজি করে মাত্র দুদিন আগে তাকে পাওয়া গিয়েছিল মগবাজারের একটা আবাসিক হোটেলে। হাতে পাওয়ার পর তাকে আর আদালতে তোলা হয়নি। দুই রাতই সে ছিল থানার গারদে।
তাকে এই হামিদুলের কথা বলেছিলেন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী সাজ্জাদ হোসেন। এর কয়েক দিন আগে তার কিছু কাজ করে দিয়েছিলেন মইন আলী। তিতাসের অফিসারদের বড় অঙ্কের ঘুষ দিয়ে তার কারখানায় লাগিয়ে দিয়েছিলেন গ্যাসের কানেকশন। ব্যবস্থা করে দিয়েছেন সোনালী ব্যাংক থেকে ৫ কোটি টাকা লোনেরও। সে সময় কিছু টাকা নিজের পকেটেও ঢুকিয়েছিলেন মইন। সাজ্জাদ সাহেবই তাকে টাকাটা দিয়েছিলেন। এভাবে-সেভাবে তাদের মধ্যে একটা ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে। ঠিক বন্ধুত্ব নয়, আসলে গড়ে উঠেছিল ব্যবসায়িক সম্পর্ক। একদিন সচিবালয়ে মন্ত্রীর অফিসে দেখা করার পর তারা যখন ফিরছিলেন, সাজ্জাদ সাহেবই মইনকে লিফট দিতে চাইলেন। হিমশীতল ফোর হুইল এসইউভির ভেতরে বসে সেদিন কথা হয়েছিল তাদের।
‘আমি একটা বড় ঝামেলায় পড়েছি ভাই।’
‘আরে ভাই, আপনার তো দেখি সমস্যার শেষ নাই।’ শাহবাগের কাছে যানজটে আটকে ছিল তাদের গাড়ি।
‘আসেন এই ব্যবসায়, তখন বুঝবেন,’ সাজ্জাদ সাহেবের মুখে হাসি।
‘না ভাই, আমারে দিয়ে ওটা হবে না। বলেন দেখি কিসের সমস্যা?’ জানতে চাইলেন মইন আলী।
‘ভাই, চাঁদাবাজির জন্য ব্যবসা করা আজকাল খুব কঠিন। প্রত্যেক মাসে চায়। প্রথমে চায় পঞ্চাশ হাজার। তারপর দাবি করে এক লাখ। আমি তো আর টাকার আড়ত নিয়া বসি নাই।’
তখনই হামিদুলের কথা বলেছিলেন সাজ্জাদ সাহেব। বলেছিলেন, ‘একটা কিছু করেন ভাই। যা লাগে আমি সব দিব।’
ওই হামিদুলের সঙ্গে কি এই তরুণের চেহারার মিল আছে? কিন্তু কীভাবে সম্ভব! সে তো...ভাবনার চোরাবালিতে মইন একটু একটু করে ডুবে যেতে লাগলেন। মনে হলো তার পায়ের তলা থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে মাটি। যেকোনোভাবেই হোক তাকে এখন শক্ত কিছুর ওপর দাঁড়াতে হবে। পা দুটো নেড়েচেড়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগলেন তিনি, যেকোনো কিছু, তার নাম, পরিচয়, ঠিকানা যা কিছু পাওয়া যায়। তিনি চেষ্টা করতে লাগলেন ওই রাতে যে ‘সন্ত্রাসীকে’ সঙ্গে নিয়ে তারা অপারেশনে বের হয়েছিলেন, তার মুখটা মনে করতে। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলেন ন। চোখ দুটো মনে পড়ছে তো নাকটা মনে হচ্ছে অন্য রকম, চুল তো কোঁকড়ানো ছিল, কিন্তু এর তো মাথায় চুলই নেই, ন্যাড়া। তাহলে? তার মনে পড়ল, ওই যুবকের নাম ছিল হামিদুল ইসলাম ওরফে মনির ওরফে কাইল্লা মনির। ওর গায়ের রংও কি এই লোকটার মতো কালো ছিল? কে জানে! রাতের অন্ধকারে ঠিকমতো দেখাও হয়নি।
‘এই যে ভাই, আপনার নাম কী?’ জিজ্ঞেস করলেন মইন আলী।
লোকটা কোনো জবাব দিল না। কিন্তু তার চোখে-মুখে তখনো লেগে আছে সেই একই হাসি।
‘হাসেন ক্যান? আপনার নাম জিজ্ঞেস করলাম না?’ অস্থির হয়ে পড়লেন মইন। কিন্তু লোকটা তখনো নির্বিকার।
ফওজিয়া দেখলেন তার স্বামী উত্তর না পেয়ে রাগে ফুঁসছে। তার চোখে-মুখেও সেটা স্পষ্ট। প্রশ্ন করলে উত্তর না পাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই মইনের। ফওজিয়া তা জানেন, এটা তিনি তার সংসারেও দেখেছেন।
মইন আলীর মনে পড়ল, ওই রাতে জিপটা নিয়ে তারা মূল সড়ক থেকে নেমে গিয়েছিলে একটা বিরানখেতের ভেতরে। তারপর সোজা গিয়েছিল আরও দশ মিনিট। জিপের ভেতরে চুপ করে বসে ছিল কাইল্লা মনির। নড়াচড়াও করেনি। তার হাত দুটো পিঠমোড়া করে বাঁধা ছিল। খালি গা। ছুরি দিয়ে কাটা লম্বা একটা দাগ ছিল বুকের ওপরে। সেলাইয়ের দাগটা দেখে চমকে উঠেছিলেন মইন। বুঝতে পেরেছিলেন বুকের বেশ ভেতরেই ঢুকে গিয়েছিল ছুরিটা। তারপরও সে কীভাবে বেঁচে গিয়েছিল একমাত্র আল্লাহই জানেন!
খাবার রেখে উঠে দাঁড়িয়েছেন মইন আলী। সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন ওই তরুণের সামনে। ‘এই শালা, তোর নাম জিগাইছি?’কোনো উত্তর এল না এই প্রশ্নেরও। বরং এল আরও এক দফা হাসি। চট করে রক্ত উঠে গেল তার মাথায়। মইন ততক্ষণে লোকটার কলার চেপে ধরেছেন। ফওজিয়া অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন এ রকম আকস্মিক ঘটনায়। দ্রুত এগিয়ে গেলেন সামনে। আশপাশের লোকজনও ত্রস্তব্যস্ত হয়ে উঠল। কিন্তু কেউ এগিয়ে যাওয়ার সাহস পেল না।
‘করছ কী তুমি, ছাড়ো।’ ফওজিয়ার অনুরোধ।
‘দেখেছ তুমি, কত বড় বেয়াদব? কয়বার জিজ্ঞেস করলাম নামটা, তুমিই বলো জয়া? জবাব দেয় না, শুধু হাসে। শালা দেখাচ্ছি মজা।’ ষাঁড়ের মতো ফুঁসে উঠলেন মইন আলী। তারপর বলতে লাগলেন, ‘শুয়োরের বাচ্চা, তুই চিনস আমারে? কে আমি, জানস?’
ফওজিয়া তার স্বামীকে টেনে নিয়ে গেলেন লোকটার কাছ থেকে। গ্লাসের পানি ঢেলে হাতটা ধুইয়ে দিলেন তার। তারপর শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে স্বামীর হাত ধরে টানতে লাগলেন। তরকারির হলুদ দাগ তখনো লেগে আছে মইনের আঙুলের ফাঁকে। ‘তুমি যে কী করো না মইন! বেশি বেশি!’
স্বামীকে শাসালেন ফওজিয়া, ‘কোথায় কার সঙ্গে কী করতে হবে, সেটাও বুঝতে পারো না।’
হাত ধরে একটু দূরে টেনে নিয়ে গিয়ে আরেকটা টুলে বসিয়ে দিলেন স্বামীকে। ফওজিয়াও তার সামনে বসে চারদিকে তাকালেন। দেখলেন সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
মইন আলী চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করলেন, ওই রাতে এরপর কী কী হয়েছিল। কাইল্লা মনিরকে তারা নিয়ে গিয়েছিল একটা বিলের ধারে। তারপর খুলে দিয়েছিল হাতের বাঁধন। চারপাশে ঝিঁঝি পোকার ডাক অসহ্য লাগছিল তার। মনে হচ্ছিল পোকাগুলো তার কানের সামনে জড়ো হয়ে চিৎকার করছে। সেই ডাক গিয়ে লাগছিল তার মগজের ভেতরে। ওই রাতে খুব বেশি দেরি করতে চাননি মইন। এত দূরে আসারও কথা ছিল না তার। কথা ছিল শুধু হামিদুলকে শনাক্ত করেই তিনি ফিরে যাবেন বাড়িতে। কিন্তু কী থেকে যে কী হয়ে গেল। একসময় তিনিও উঠে পড়লেন পুলিশের গাড়িতে। তার মনে আছে, কাইল্লা মনির এসআই জমিরকে শুধু বলছিল, ‘ছার, আমারে মাইরেন না ছার। আমারে কোর্টে দ্যান। জেলে দ্যান। আমারে মাইরেন না ছার।’
হামিদুলের ওই কাকুতি–মিনতি চাপা পড়ে গিয়েছিল ঝিঁঝি পোকার কুৎসিত ডাকের আড়ালে।
তারপর মনিরের হাত দুটো খুলে বলা হয়েছিল দৌড় দিতে। সে দৌড়ায়নি তখনো। বরং দাঁড়িয়ে ছিল ওদের সামনেই। এক ফাঁকে বসে পড়েছিল মাটিতে। মইন আর এসআই জমিরের পা-ও জড়িয়ে ধরেছিল কয়েকবার। কিন্তু তাকে মাটি থেকে উঠিয়ে ধমকের সুরে বলা হয়েছিল দৌড় দিতে। ‘শুয়োরের বাচ্চা দৌড়া...এইখান থাইক্কা...পালা, খানকির পোলা।’
‘ছার, আমারে মাইরেন না ছার,’ কাঁদতে লাগল হামিদুল। এসআই জমির তখন তার পাছায় একটা লাথি দিলে সে কাদার মধ্যে উল্টো হয়ে পড়ে গেল। ‘চুতমারানির পোলা দৌড়া। নাইলে মরবি। যা ভাগ।’
হামিদুল তখন দিল দৌড়। বিলের পাড় ধরে ছিল সেই দৌড়। নরম মাটির ভেতরে বসে যাচ্ছিল হামিদুলের পা। দৌড়াতে পারছিল না ঠিকমতো। একবার দুবার পড়ে গিয়ে সে কোনোরকমে উঠে আবারও দৌড়াতে শুরু করল।
এর কিছুক্ষণ পরেই একটা গুলির আওয়াজ হলো। তারপর আরও একটা। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে শোনা গেল আরও একটা আওয়াজ। মোট তিনটা। গুলির আওয়াজ বিলের ওপারের কয়েকটা বাড়িঘরে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল মইনের কানে। সে সময় ভয়ে চুপ করে গিয়েছিল সব ঝিঁঝি পোকাও। রাতের সেই নিস্তব্ধতা কাচের গ্লাসের মতো চুরমার করে ভেঙে দিয়ে এলোপাতাড়ি বেজে উঠল এস আই জমিরের হুইসেল।
‘এই তোরা লাশ ওঠা।’
‘খাতায় কী লিখমু স্যার,’ একজন জানতে চাইল। এসআই জমির তখন টর্চলাইটটা ধরে রেখেছে পুলিশের রেকর্ডবুকের ওপর। আর সেখানে খস খস করে লেখা হলো—একটা পিস্তল, এক ডজন বিচি আর ৫০টা ইয়াবা।
‘তিনটা খোসা পাস কি না দেখ,’ বললেন এসআই জমির।
মইন আলীর মনে হলো, এই তরুণই কি ওই রাতের হামিদুল ওরফে কাইল্লা মনির? তার সঙ্গে তো তিনি এখন অনেক কিছুরই মিল পাচ্ছেন। মনে হচ্ছে ওদের গায়ের রং এক, চোখটাও তার চোখের মতো। ওই রাতে সে যখন ‘আমারে মাইরেন না, ছার আমারে মাইরেন না’ বলে জীবন ভিক্ষা চাইছিল, তখন তার চোখ দুটোও এই যুবকের চোখের মতোই লাগছিল। একই রকমের উজ্জ্বল আর একই রকমের জলে টলমল দুটো চোখ। কিন্তু সেটা তো কিছুতেই সম্ভব নয়। পোস্টমর্টেমের পর ওর লাশ তুলে দেওয়া হয়েছিল আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে। ওরা তাকে কবর দিয়েছে আজিমপুর কবরস্থানে।
আরেকবার নিশ্চিত হতে মইন আলী তাকালেন ওই তরুণের দিকে। দেখলেন তার চোখ দুটো লাল। রক্তজবার মতো। তার মনে পড়ল হামিদুলের ভয়ার্ত মুখ। কিন্তু এই তরুণের মুখেও সেই একই হাসি। মইনের মনে হলো, সে তাকে ব্যঙ্গ করছে। মাথায় চড়াৎ করে আবার রক্ত উঠে গেল তার। মুহূর্তে ছুটে গেলেন ওই তরুণের কাছে। ঠাস ঠাস করে দুটো চড় মারলেন দুই গালে। হোটেলের ম্যানেজার দৌড়ে গিয়ে মইনের হাত থেকে ওই তরুণকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল।
‘কী করেন ছার, ছাড়েন ওরে,’ ম্যানেজার অনুরোধ করল।
‘আপনেরা দেখেছেন, কেমন বেয়াদব পোলা।
কতবার নাম জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু কিছুই বলে না।’
ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন লোক এগিয়ে গেল ওদের সামনে। সবাই মিলে লোকটিকে মইন আলীর থাবা থেকে ছাড়িয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
ফওজিয়া দেখলেন, ধস্তাধস্তিতে তরুণের শার্টের সামনের দিকে ওপরের সব কটি বোতাম ছিঁড়ে গেছে।
‘ছার, হেয় তো বোবা, কথা কইতে পারে না।’
উত্তেজনা আর হই–হট্টগোলের মধ্যে মইন আলী দূর থেকে ম্যানেজারের এই কথাটা ঠিকমতো শুনলেন কি না বোঝা গেল না।
কিন্তু তিনি দেখতে পেলেন, তরুণের শার্টটা যেখানে ছিঁড়েছে, সেখানে—ঠিক বুকের মাঝখানে, ছুরি দিয়ে বসানো একটা লম্বা কাটা দাগ। সেলাই দেখেও বোঝা যায় বুকের ওই ক্ষত কতটা গভীর ছিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন