মানবিক গুনাবলি ভুলতে বসেছে মানুষ...............!

            পৃথিবীটা যদি শুধু ধণাঢ্যদের আবাসভূমি হত তবে নিশ্চিত করে বলা যায়, ধরণীটা এত সুন্দরভাবে সাজানো থাকত না । ধণীরা অর্থের বিনিময়ে নিজেদেরকে পরিপাটি করিয়ে রাখতে পারে কিন্তু নিজেদের ক্ষমতায় পরিপাটি হওয়ার ক্ষমতা তাদের নাই; অন্তত বর্তমান বিশ্বের ধণীদের জীবন-যাপন দেখে এমনটাই অনুমেয় । বৃত্তশালীদের সকাল থেকে শুরু করে ঘুমুতে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এমনকি ঘুমের সময়টাতেও সেবক-সেবিকার সাহায্য লাগে । ধণের মাপকাঠিতে ধণাঢ্যদেরও আবার রকমফের আছে । উচ্চ বৃত্তের, মধ্য বৃত্তের আবার কেউ উচ্চ-মধ্য বৃত্তেরসহ আরও কত কি। স্রষ্টাও তার সৃষ্টিতে এমন বৈচিত্র্য দিয়েছেন যাতে মানুষের দ্বারাই মানুষ পরিপূর্ণতা অর্জন করতে পারে। তবে পার্থক্য শুধু এটুকুই, মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ মানুষের জন্য পৃথিবীর অবশিষ্ট জনগোষ্ঠী দিনরাত পরিশ্রম করে চলছে। কেননা জন্মগতভাবেই এমনভাবে সম্পদের বন্টন নির্ধারণ করা হয়েছে যার গন্ডী ছাপিয়ে নবযাত্রার সূচনা করা আদৌ সম্ভব নয় ।
রাজা, জমিদার কিংবা বৃত্তশালীদের বংশধরেরা উত্তরাধিকারী সূত্রেই পদবী ও বিত্তের মালিক হচ্ছে অন্যদিকে প্রজাদের সন্তান জন্ম নিয়েই তাদের উর্ধ্ববংশের প্রভূদের সেবা যত্ন করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে । পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র কাঠামোকে যুগ-যুগান্তর ধরে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যার কারণে পূর্ব-শৃঙ্খলা থেকে বের হওয়ার পথ মোটেও প্রশস্থ নয় । তারপরেও যে কিছু ব্যতিক্রম পৃথিবীবাসী প্রত্যক্ষ করেনি তা নয় । কেউ পরিশ্রমের ফল স্বরূপ অলৌকিক সৌভাগ্যবশত কিংবা বাহু-শক্তি চর্চায় বীরের পরিচয় স্থাপন করে বৃত্তশালীদের কাতারে দাঁড়ায় কিন্তু তার সংখ্যা অতি সামান্য। স্রষ্টার সৃষ্টি রহস্যতেই যেহেতু কেউ আমীর আর কেউ ফকিরের সম্পর্কে যুক্ত কাজেই এখানে যুক্তি-তর্ক খুব বেশি সূফল দিতে ব্যর্থ । তবুও মানব ইতিহাসের প্রারম্ভ থেকে স্রষ্টা মানুষের মধ্যে এমন কতগুলো মানদন্ড নির্ধারণ করে দিয়েছে যার ফলে ধণ-দৌলতের অসীম পার্থক্য থাকার পরেও মানুষে মানুষে কোন বিভেদ কিংবা মর‌্যাদাগত পার্থক্য থাকার কথা নয় । যেখানে সঠিক ধর্মের স্পর্শ লাগেনি সেখানের জন্য ভিন্ন কথা । তবে যারা ধর্মকে ঐশ্বরিক বিধান বলে অস্বীকার করেছে তারাও মানুষের সম্মান ও সম-মর‌্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছে । তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, যারা মানুষের সম-মর্যাদার স্লোগান তুলে বিশ্বের দরবারে সাড়া ফেলেছিল সেই তাদের পক্ষ থেকেই এ বিধান লঙ্ঘিত হয়েছে সবেচেয়ে বেশি । তাদের স্বার্থের কাছে কোন নীতিবাক্য জয়ী হতে পারেনি । স্বীকৃতভাবে শুধু হিন্দু ধর্মে মানুষের স্পষ্ট স্তর বিন্যাস রয়েছে (ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র) এবং তাদের মধ্যে তা মান্য করার মানসিকতা থাকলেও বর্তমানে সকল ধর্মের মানুষ মানুষেরকে অর্থের মাপকাঠিতে বিবেচেনা করে মানুষকে সামাজিকভাবে বিভিন্ন স্তরের মর‌্যাদায় অধিষ্ঠিত করছে । বৃত্তশালীদের সীমানায় যেমন অর্থহীনের প্রবেশ নিষেধ তেমনি অর্থহীনদেরকে বৃত্তশালীরা মানুষ বলে বিবেচনা করার মানসিকতাও দিন দিন ত্যাগ করছে । আনুষ্ঠানিকভাবে পৃথিবীতে হয়ত দাস প্রথা পূণরায় ফিরে আসার সম্ভাবনা কখনও দেখা যাবে না কিন্তু বর্তমানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দাস প্রথার সমতুল্য কিংবা আরও জঘন্য কিছু ঘৃণ্য প্রথার অনু্প্রবেশ আবারও ঘটতে যাচ্ছে বলে পূর্ব লক্ষণ স্পষ্ট হতে শুরু করেছে । মানুষ যদিও দিন দিন সভ্যতার নাগাল পেতে ছুঁটছে তবুও বর্বরতা থেকে খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে বলে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না ।
গত শতাব্দীতে সাম্য ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম মানুষের মধ্যে সৃষ্ট কৃত্রিম বিভেদ দেখে যেভাবে ঘোষণা করেছিলেন, ‘দেখিনু সেদিন রেলে, কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে ! চোখ ফেটে এল জল, এমনি ক’রে জগৎ জুড়িয়া মার খাবে কি দুর্বল’ ? তখনকার কবির অভিব্যক্তির সাথে বর্তমান বাস্তবতায় খুব বেশি পার্থক্য হয়েছে বলে স্বাক্ষী দেয়ার সৎ সাহস ধরাবাসী আজও সঞ্চয় করতে পারছে বলে বিশ্বাস নয় । দিনে দিনে মানুষের মধ্যে সম্পদের পার্থক্য যেমন বেড়েছে তেমনি বাড়ছে মর‌্যাদাগত দূরত্ব । যে দূরত্ব হয়ত কোনদিনই আর কমানো যাবে না । কারণ মানুষের মানবিক গুনাবলী ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে এবং এরা যেন যান্ত্রিক যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে । সর্বব্যাপী এখন কেবল ধণ আহরণ ও সঞ্চয়ের প্রতিযোগিতা । যার ধণ আছে সে সমাজ ও রাষ্ট্রে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মর‌্যাদা পাচ্ছে । এক্ষেত্রে ধণবানের পেশা কিংবা নীতি-নৈতিকতা কোন বাধার সৃষ্টি করছে না । তাইতো কিছুটা বাস্তববাদীরা সাহস করেই উচ্চারণ করেছে, টাকাই দ্বীতিয় ঈশ্বর । সবার একটাই লক্ষ্য টাকা চাই, অঢেল টাকা । কিন্তু যারা জন্মগতভাবে কোটিপতি এবং যারা নিঃস্ব-এ দু’য়ের মধ্যে কি প্রতিযোগীতা চলে ? প্রতিযোগীতার নামে যা হয় তা অসম তবুও প্রতিযোগীতা হওয়া মন্দ নয় কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্র ধণী-দরিদ্র্যের মধ্যে এমনকতগুলো বৈষম্যের সৃষ্টি করে রেখেছে যার কারণে, ধণী আরও ধণের অধিকারী এবং গরীব আরও নিঃস্ব হবে ।

সম্মান ব্যক্তির নয় বরং পোশাকের-ফার্সী ভাষার বিখ্যাত কবি শেখ সাদী রচিত বিখ্যাত এ গল্পটি হয়ত আমরা সকলেই জানি । বর্তমানের বাস্তবতাও গল্পের ব্যতিক্রম নয় । ইসলাম ধর্মে মানুষের মধ্যে সাম্য ও ভ্রাত্বের কথা দৃঢ়ভাবে ঘোষিত হয়েছে । ইসলামের প্রাথমিক যুগে মানুষে মানুষে সাম্যতা ও ভ্রাত্বের নজিড় স্থাপিত হয়েছিল । ইসলামের সে বৈশিষ্ট্য দেখে দলে দলে মানুষ ইসলামের ছায়া তলে আশ্রয় নিয়েছিল । ভালো কাজ/নিয়ম নীতি পৃথিবীতে দীর্ঘস্থায়ী থাকে না । মানবতার মুক্তির দুত হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) প্রচারিত ইসলামের বয়স মাত্র কয়েকশ’ বছর পার হতে না হতেই ইবলিশ চরিত্রের মানুষ রূপী কিছু মুসলিম নামের মুখোশধারী ইসলামের অধিকাংশ মহৎ শিক্ষাকে স্বীয় হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বদলে দেয়ার গভীর ষড়যন্ত্র করে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলতাও পায় । আবারও রাজার দ্বারা প্রজার, মানুষরূপী প্রভূ দ্বারা সেবকের অধিকার লঙ্ঘিত হতে শুরু করে । তবে কিছু মানুষ প্রতি যুগেই ইসলামের পূর্ণ শিক্ষা নিয়ে ইসলামের হারানো আদর্শে ফিরে যেতে চেষ্টা করেছে বটে কিন্তু পূর্ণভাবে সফলতা পায়নি । গভীর ষড়যন্ত্র এবং স্বার্থপরদের অশুভ তৎপরতায় ইসলামের পূর্ণ আদর্শ বাস্তবায়ণ না হওয়ায় এখানেও মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে । তবুও অন্যান্য দিকের তুলনায় ইসলামে এখনও মানুষে মানুষে কিছুটা হলেও সাম্যতা আছে । আর কোথাও না হোক অন্তত নামাযের সাড়িতে দাঁড়ানোর সময় কে আমীর আর কে ফকির তার পার্থক্য থাকে না । ইসলামের এ মহান শিক্ষা মানুষের হৃদয়ে খুব বেশি সময় স্থায়ী হতে না দেয়ার জন্য একটি মহল ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে । মানুষের মনে জাগ্রত পশুত্ব ধর্মীয় মূল্যবোধ ও বিবেককে ঘুম পড়িয়ে রাখতে সদা জাগ্রত ।

যখন মানুষ মানুষকে অর্থের মানদন্ডে সম্মান দেখায় তখন প্রকৃত মানুষের খুব কষ্ট হয় । কিছু কিছু ক্ষেত্রে যার অর্থ আছে তার কাছে গিয়ে সম্বলহীনকে মাথানত করতে বাধ্য করা হয় এবং যিনি অর্থহীন তাকে সামান্য সম্মানটুকুও প্রদান করা হয় না । সম্বলহীনের সাথে সম্পদশালীর আচার-ব্যবহার দেখলে যেন মনে হয় চতুষ্পদ পশুর সাথে তার রাখাল আচরণ করছে । অর্থ হলেই মানুষ ভূলে যায় তার সব দায়িত্ব ও মানবতাবোধ । তখন আর গরীব ও অসহায় মানুষদেরকে মানুষ বলেই মূল্যায়িত করা হয়না অথচ এই অসহায় ও গরীব মানুষগুলো না থাকলে সঠিক ও ‍সুন্দরভাবে এক মূহুর্ত পার করার কি কোন সাধ্য ছিল ? দেশের পরিছন্নকর্মীরা যদি মাত্র দু’দিন তাদের দায়িত্ব পালন না করে তাহলে কি রাস্তায় বের হওয়ার সাধ্য থাকবে ? বৃত্তশালীরা ঘুম থেকে জাগার আগেই যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে দিনকে মানুষের জন্য স্বাভাবিক ও সুন্দরভাবে চলার জন্য সাবলীল করে দেয় সেই তাদের কথা কতটুকু ভেবেছি ? তাদের সাথে কি নিছক ভদ্রতাটুকুও দেখানো হয় ? মেথর, কুলি, মজুর, ঠেলাওয়ালা, রিকসাওয়ালা, তাঁতী, কামার, কুমোর, জেলে, মুচি, নাপিত, ধোঁপা, মিস্ত্রী, গৃহ-পরিচারিক, ড্রাইভার, হেলপার কিংবা সমজাতীয় পেশাজীবিদের সম্মান দিয়ে কতটুকু কথা বলা হয় ? সামাজিকভাবে এদের সম্মান কতটুকু ? কোন স্বার্থে কিংবা কার স্বার্থে এদের জন্য সমাজে সংকীর্ণ সীমানা নির্ধারণ করা হল ? বর্বর যুগে দাস-দাসীদের সাথে যেরূপ আচরণ করা হত তার চেয়ে খুব ভালো আচরণ কি এই সভ্য যুগে এদের সাথে করা হচ্ছে ? মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় তারা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। যোগ্যতা ও পেশাগত কারণে ক্ষণিকের জন্য কিছুটা পার্থক্য মেনে নেয়া যেতে পারে কিন্তু সে পার্থক্যকে স্থায়ী রূপ দেয়ার মানসিকতা নিশ্চয়ই ঘৃণিত বলেই বিবেচ্য হওয়া উচিত ।

প্রাচীন যুগের মহামতি দার্শনিক প্লেটো তার কল্পিত কল্যান রাষ্ট্রে সকল মানুষকে সম-মর‌্যাদা প্রদানের পরিকল্পনা করেছিলেন কিন্তু তখন তা বাস্তবায়ণ সম্ভব হয়নি । আজও হয়ত তা সম্ভব হবে না কিন্তু যতটুকু দরকার ততটুকু পরিবর্তন তো আনয়ণ করা যেতেই পারে । সে পরিবর্তন আমাদেরকেই আনতে হবে । এজন্য দরকার মানবিক গুনাবলির বিকাশের জন্য ছোটখাট বিপ্লবের । যে বিল্পব ঘুমন্ত বিবেককে জাগ্রত করার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সাম্য-ভ্রাতৃত্ব পূণঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে । যেখানে রাজা-প্রজায় কোন ভেদাভেদ থাকবে না । সবার প্রথম পরিচয় হবে মানুষ তারপর দরকার হলে অন্যকিছু । শুধু সচেতনতার ও মানবিক আচরনের চর্চার মাধ্যমে এ পরিবর্তন আনা সম্ভব । ব্যক্তি প্রচেষ্টাতেই বিপ্লবের নব-দিগন্তের উম্মোচন হওয়া বাঞ্চনীয় । কবির মত আমরাও যেন বলতে পারি, ‘আসিতেছে শুভ দিন, দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ’ ।
(collected)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

সিঙ্গাপুরে ওয়ার্ক পারমিটধারীদের জন্য নতুন নিয়ম: চাকরির মেয়াদ সীমা বাতিল, সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৬৩ বছর
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস
সিঙ্গাপুরে ট্রেইনিং রেকর্ড এবং সার্টিফিকেট চেক করার বিস্তারিত গাইড
Bangla date add in your website HTML tips.
some common interview questions and answers for a Safety Coordinator position in Singapore
ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল তিন বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষার্থীদের আল্টিমেটাম
Understanding the New Demerit Point System for Construction and Manufacturing Sectors
Safe work procedure for ferrying workers by lorry in singapore
বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য সিঙ্গাপুরে কম খরচে দাঁতের চিকিৎসা
সিঙ্গাপুর কর্মস্থলের নিরাপত্তা আইন শক্তিশালী করছে এবং নতুন আইন প্রবর্তন করছে
Loading posts...