সিঙ্গাপুরে নিরাপত্তা কাজে শ্রীলঙ্কান, ফিলিপাইন, মিয়ানমার, চীন ও ভারতের নাগরিকদের নিয়োগ বাড়ছে
ত্রিশের কোঠার এক শ্রীলঙ্কান নাগরিক বর্তমানে সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরে অক্সিলিয়ারি পুলিশ অফিসার (APO) হিসেবে কাজ করছেন। নিজের পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তিনি জানান, শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক মন্দার সময় এই চাকরিটিই তাঁর পরিবারের জন্য সবচেয়ে বড় ভরসা।
তিনি বলেন, “সিঙ্গাপুরে কয়েক মাসেই আমার দক্ষতা, যোগাযোগ ও শৃঙ্খলা অনেক বেড়েছে। আমি বিদেশে কাজ করছি ঠিকই, কিন্তু আমার নিয়োগকারীরা খুবই ভালোভাবে আমাকে দেখাশোনা করছেন। কোনো বৈষম্যের শিকার হইনি। শুধু সন্তানকে মিস করলেই একটু একাকীত্বে ভুগি।”
সিঙ্গাপুরে সম্প্রতি যে সকল বিদেশি অক্সিলিয়ারি পুলিশ নিয়োগ পাচ্ছেন, এই শ্রীলঙ্কানও তাদের একজন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে সিঙ্গাপুর এই বাহিনীতে শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, মিয়ানমার, চীন ও ভারতের নাগরিকদের নিয়োগ শুরু করে। আগে এই বাহিনীতে মালয়েশিয়া ও তাইওয়ান থেকেই মূলত লোক নিয়োগ হতো।
অক্সিলিয়ারি পুলিশ অফিসাররা বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, জনসমাগম, নিরাপত্তা স্ক্রিনিং বা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করে থাকেন। এদের কেউ কেউ অস্ত্রধারীও হতে পারেন, তবে তারা অপরাধ তদন্ত করেন না।
সিঙ্গাপুরের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী কমে যাওয়ায় এবং নিরাপত্তা সেবার চাহিদা বাড়ায়, ২০২৪ সালে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (Ministry of Home Affairs) আরও কিছু দেশের নাগরিকদের নিয়োগের অনুমতি দেয়।
২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত তাইওয়ান ও মালয়েশিয়ার নাগরিকেরা মোট APO-দের ৩২ শতাংশ গঠন করছিলেন। বাকি ৬৮ শতাংশ ছিলেন সিঙ্গাপুরের নাগরিক। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জোসেফিন টিও সংসদে জানান, ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত বিদেশি অফিসারদের সংখ্যা মোট APO বাহিনীর প্রায় ৩ শতাংশ।
শ্রীলঙ্কার সরকারি প্রতিষ্ঠান Sri Lanka Foreign Employment Agency (SLFEA) জানায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত তারা ৬১ জনকে সিঙ্গাপুরে APO হিসেবে পাঠিয়েছে। সর্বশেষ ব্যাচ গেছে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে।
SLFEA-এর বাণিজ্য উন্নয়ন ব্যবস্থাপক কালানি গামাগে বলেন, “সিঙ্গাপুরে ভালো বেতন ও উচ্চমানের আবাসনের কারণে শ্রীলঙ্কানদের মধ্যে এ ধরনের চাকরিতে আগ্রহ বাড়ছে। ৫,০০০-এর বেশি আবেদন এসেছিল। ইংরেজি সাক্ষাৎকার ও শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যদের বাছাই করা হয়েছে।”
বিজ্ঞাপন অনুযায়ী, শ্রীলঙ্কা থেকে নিয়োগ পাওয়া অফিসারদের মাসিক বেতন ১,০০০ থেকে ১,৭০০ সিঙ্গাপুর ডলার, যা শ্রীলঙ্কান মুদ্রায় ২,২২,০০০ থেকে ৩,৭৭,৪৪০ রুপি। এই বেতন শ্রীলঙ্কার গড় মাসিক আয়ের (প্রায় ৬৫,০০০ রুপি) তিন থেকে চার গুণ বেশি।
নিয়োগে ইংরেজিতে দক্ষতা ও অন্তত তিনটি GCE N বা O লেভেল থাকতে হয়। পাশাপাশি শারীরিক পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হতে হয়, যার মধ্যে রয়েছে সিট-আপ, পুশ-আপ ও ১৫ মিনিটে ২.৪ কিমি দৌড়।
তাইওয়ান থেকে নিয়োগ কমে যাওয়ায় সিঙ্গাপুর নতুন দেশগুলোর দিকে নজর দেয়। ২০১৭ সালের তুলনায় তাইওয়ান থেকে APO নিয়োগ ৬০ শতাংশ কমে গেছে।
সিঙ্গাপুরে রিক্রুটমেন্ট কোম্পানি Inter Island Group-এর ম্যানেজার ওয়েন টসেং জানান, গত পাঁচ বছরে তার কোম্পানি প্রায় ১৩০ জন তাইওয়ানিজকে সিঙ্গাপুরে APO হিসেবে পাঠিয়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রায় ১০ জন তাইওয়ানিজ অফিসার গেছেন।
তিনি বলেন, কিছু APO-র শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে কাজ হলেও অনেককে বাইরে রোদের মধ্যে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়—এই ভিন্নতা নিয়ে অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এছাড়াও, ইংরেজি জানা না থাকলে চাকরির সুযোগ কম এবং যাঁরা ইংরেজিতে পারদর্শী, তাঁরা তাইওয়ানেই অন্য ভালো চাকরি পেয়ে যান। নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি ও অপরাধমুক্ত রেকর্ড আবশ্যক।
তবে আকর্ষণীয় বেতন এখনও অনেকের আগ্রহের কারণ। সাধারণত সিঙ্গাপুরে একজন APO-এর মাসিক বেতন ৩,৬০০ সিঙ্গাপুর ডলার, যা তাইওয়ানের গড় মাসিক বেতনের দ্বিগুণ।
সিঙ্গাপুরে বিদেশি APO নিয়োগ নিয়ে কিছু নাগরিক উদ্বেগ প্রকাশ করলেও, এনটিইউ-এর (NTU) বিশেষজ্ঞ মিস লো বলেন, “এই চাকরিগুলোতে সংবেদনশীল তথ্য বা গোপন নথিপত্রে প্রবেশাধিকার থাকে না।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে অধিকাংশ সিঙ্গাপুরবাসী উচ্চ শিক্ষিত ও উচ্চ আকাঙ্ক্ষার ফলে এমন পরিশ্রমী পেশাগুলো নিতে চান না। ফলে বিদেশিদের মাধ্যমে এই শূন্যস্থান পূরণ করাটাই বাস্তবতা।”
0 মন্তব্যসমূহ