ফিরে আসা (লাশ হয়ে দেশে) Probashir Lash

 


গল্প: ফিরে আসা (লাশ হয়ে দেশে)

প্রথম অংশ: স্বপ্নের ডানায় ভর করে

বাবা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। হাতে একটি ছোট্ট ব্যাগ, আর চোখে ভেজা স্বপ্ন।

—“বাবা, এতদিনে তোমারও বিদেশ যাওয়ার সময় হলো।”
—“হ্যাঁ বাবা, সব ঠিকঠাক হলে তোমার কষ্ট থাকবে না আর।”

মা কাছে এসে বলল—
—“খুব খেয়াল রাখিস নিজের। খালি পেটে কাজ করিস না।”
আরিফ মায়ের হাত ধরে উত্তর দিল—
—“চিন্তা কইরো না মা, আমি ভালো থাকব। তোমরা শুধু দোয়া করো।”

বোন কেঁদে ফেলল—
—“ভাইয়া, তুই টাকা পেলেই আমার পড়ার খরচ দিবি তো?”
—“অবশ্যই দেবো। তুই ডাক্তার হবি, মা-বাবাকে সুখ দিবি।”

বিমান ছাড়ার সময় আরিফ নিজেকে বলল—
“বিদেশ মানে স্বপ্ন, বিদেশ মানে সুখ।”
কিন্তু সে জানত না—
বিদেশ মানে হয়তো একদিন কফিনে ভরে ফিরে আসা।


দ্বিতীয় অংশ: প্রবাসের প্রথম দিনগুলো

সিঙ্গাপুরে নামতেই অচেনা শহর, অচেনা মানুষ। নির্মাণস্থলের ফোরম্যান কড়া স্বরে বলল—
—“Eh you, faster, faster! Work must finish today!”

আরিফ মাথা নিচু করে কাজ শুরু করল। দুপুরের রোদে ঘাম ঝরছে, হাতের তালুতে ফোসকা পড়ছে। রাতে ক্লান্ত শরীরে ফোন ধরল।

—“মা, কেমন আছো?”
—“ভালো আছি রে। তুই কেমন?”
—“আমি ভালো আছি। শুধু একটু কাজ বেশি।”
(চোখের জল সে লুকিয়ে রাখল, যেন মা কষ্ট না পান।)


তৃতীয় অংশ: জীবনযুদ্ধ

দিন যায়, মাস যায়। টাকার রেমিটেন্স দেশে পৌঁছে যায়। বাবার চিকিৎসা হয়, বোনের স্কুল ফি জমা হয়, মায়ের জন্য ওষুধ কেনা হয়।

সহকর্মী হোসেন একদিন বলল—
—“আরিফ, এত কষ্ট করিস কেন? শরীরের খেয়াল রাখ।”
—“ভাই, শরীরের কষ্ট সহ্য করা যায়। কিন্তু মায়ের মুখের কষ্ট সহ্য হয় না।”

তবুও শরীরের ভেতর জমানো ক্লান্তি বাড়তেই থাকে।


চতুর্থ অংশ: সেই দিন

দুপুরের রোদ মাথায় চেপেছে। আরিফ  দাঁড়িয়ে কাজ করছিল। হঠাৎ হাত থেকে যন্ত্র পড়ে গেল।

—“Eh! What happen?” সহকর্মীরা ছুটে এলো।
আরিফের ঠোঁট কাঁপল—
—“মা…”
তারপরই নিঃশ্বাস থেমে গেল।

ডাক্তার বলল—
—“Heat stroke. Too late.”


পঞ্চম অংশ: দেশে ফেরা

এক সপ্তাহ পর বিমানবন্দরে লম্বা ভিড়। কাঠের বাক্স নামানো হলো। বাবার হাত কাঁপছে, চোখে জল—

—“আরিফ, তুই তো সুখ দিতে গেছিলি। এ সুখটা কেমন রে বাবা?”

মা কফিন জড়িয়ে চিৎকার করে উঠল—
—“আমার ছেলেকে ফেরত দাও! ও তো বলেছিল ভালো থাকবে!”

বোন কাঁদতে কাঁদতে বলল—
—“ভাইয়া, তুই তো আমার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নটা পূরণ করার কথা বলেছিলি…”

গ্রামের মানুষ চুপচাপ দাঁড়িয়ে। কারও মুখে শুধু একটা কথা—
“প্রবাস মানে শুধু টাকা নয়, প্রবাস মানে অনেক লাশ।”


শেষ প্রশ্ন

হাজারো তরুণ প্রতিদিন একই স্বপ্ন নিয়ে প্রবাসে যায়। কেউ সুখ নিয়ে ফেরে, কেউ কাঠের বাক্সে।

তাহলে প্রশ্ন রয়ে যায়—
পরিবারের স্বপ্ন কি সন্তানের জীবনের চেয়ে বড়? প্রবাস কি সত্যিই সুখ দেয়, নাকি শুধু কান্নার ইতিহাস বানায়?


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Loading posts...