মোবাইল অতিরিক্ত স্ক্রলিং আমাদের মানসিক প্রশান্তি নষ্ট করতে পারে এবং কীভাবে এড়ানো যায়?


🔊 Listen to This Blog Post

মোবাইল  অবিরাম স্ক্রলিং: কেন এটা এত আসক্তিকর এবং কীভাবে এড়ানো যায়?

একটা কুকুরছানার মজার ভিডিও, তারপর সমুদ্রপাড়ে তোলা পুরনো বন্ধুর ছবি, এরপর একটা ভাইরাল মিম, আর তারপর বিশ্বের অন্যপ্রান্তের একটা গুরুত্বপূর্ণ খবরের ভিডিও—এইভাবেই চলতে থাকে আমাদের প্রতিদিনের স্ক্রলিং! ভালো লাগলে দেখি, ভালো না লাগলে ‘পাস’ করে যাই।

কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন, আমরা কেন এতটা স্ক্রলিং করতে থাকি? কেন ফোনের স্ক্রিনে একবার চোখ রাখলেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়? বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি শুধু অভ্যাস নয়, বরং এটি আমাদের মস্তিষ্কের গভীরে প্রভাব ফেলে।

স্ক্রলিং কেন এত আসক্তিকর?

লিডস্ বেকেট ইউনিভার্সিটির সাইকোলজি বিভাগের সিনিয়র লেকচারার এইলিশ ডিউক ব্যাখ্যা করেছেন, ফোন হাতে নেওয়ার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবেই স্ক্রলিং করতে থাকি, এবং এই অভ্যাসটি এতদিন ধরে গড়ে উঠেছে যে আমরা বুঝতেই পারি না।

আমরা স্বভাবগতভাবে কৌতূহলী। চারপাশে কী ঘটছে, সেটা জানার আগ্রহ আমাদের সহজাত। তাই খবর পড়ি, দুর্ঘটনা দেখলে থেমে যাই, এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অজান্তেই স্ক্রল করতে থাকি। প্রযুক্তি নির্মাতারা আমাদের এই প্রবৃত্তিটিকে কাজে লাগিয়ে অ্যাপগুলো ডিজাইন করেছেন, যাতে আমরা তথ্যের জালে আটকে থাকি।

স্ক্রলিংয়ের আসক্তির পেছনে মস্তিষ্কের ভূমিকা

নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির সাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক আরিয়েন লিং বলেন, আমাদের মস্তিষ্ক পুরস্কারপ্রিয়। আনন্দের অনুভূতি পাওয়ার পর এটি বারবার তা পেতে চায়।

সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা প্রতিনিয়ত নতুন কিছু দেখি—একটি মজার ভিডিও, আকর্ষণীয় ছবি, মজাদার পোস্ট বা নতুন মেসেজ। আমাদের মস্তিষ্ক এগুলো দেখে আনন্দ অনুভব করে, এবং এটি অবচেতনভাবে স্ক্রলিং চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করে।

কিন্তু মস্তিষ্কের আরেকটি অংশ, প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স, আমাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে এবং যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। যারা অতিরিক্ত স্ক্রলিং করেন, তাদের ক্ষেত্রে এই অংশটি ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, যার ফলে তারা স্ক্রলিং বন্ধ করতে চাইলেও পারছেন না।

বিশেষ করে কিশোর ও তরুণদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়, কারণ ২৩-২৪ বছর বয়সের আগে তাদের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স পুরোপুরি পরিণত হয় না। ফলে তারা সহজেই সোশ্যাল মিডিয়ার নেশায় ডুবে যায়।

কেন স্ক্রলিংয়ের সময় আমরা সময়ের হিসাব রাখতে পারি না?

অধ্যাপক ডিউকের মতে, স্ক্রলিং করার সময় আমরা একপ্রকার ‘ফ্লো স্টেট’-এ চলে যাই। এটি এমন একটি অবস্থা যখন আমরা কোনো কাজে এতটাই মগ্ন হয়ে যাই যে সময় কেটে যায় টেরই পাই না।

টিকটক, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর অ্যালগরিদম আমাদের পছন্দ অনুযায়ী কনটেন্ট সরবরাহ করে, ফলে আমরা একের পর এক ভিডিও বা পোস্ট দেখে যেতে থাকি। এতে সময়ের ধারণা হারিয়ে ফেলি এবং কখন যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়, বুঝতেই পারি না।

অধ্যাপক লিং এটিকে একটি রূপকের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন—“একটি পথে বারবার হাঁটলে সেটি আমাদের জন্য সহজ হয়ে যায়। তেমনি, বারবার স্ক্রলিং করলে এটি আমাদের স্বাভাবিক অভ্যাসে পরিণত হয়, ফলে এটি বন্ধ করাও কঠিন হয়ে পড়ে।”

স্ক্রলিংয়ের আসক্তি কমানোর উপায়

অতিরিক্ত স্ক্রলিং আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই এটি নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। এখানে কিছু কার্যকর কৌশল দেওয়া হলো:

১. নির্দিষ্ট সময় স্ক্রিন থেকে দূরে থাকা

অধ্যাপক লিং বলেন, “ফোন থেকে নিজেকে কিছু সময় দূরে রাখার চেষ্টা করুন।”

যদি সম্ভব হয়, হাঁটতে বের হন, জিমে যান, বা অন্য কোনো শারীরিক কার্যকলাপে ব্যস্ত থাকুন। ফোন ছাড়াই সময় কাটানোর অভ্যাস গড়ে তুলুন।

২. বাস্তব জীবনের মিথস্ক্রিয়া বাড়ানো

অতিরিক্ত স্ক্রলিং কমাতে হলে বাস্তব জীবনের মিথস্ক্রিয়া বাড়ানো জরুরি।

উদাহরণস্বরূপ, সময় দেখার জন্য ফোনের পরিবর্তে ঘড়ি ব্যবহার করুন। এতে অপ্রয়োজনে ফোন হাতে নেওয়া কমে যাবে এবং স্ক্রলিংয়ে আটকে পড়ার সম্ভাবনাও কমবে।

৩. নিজের গতিপথ পরিবর্তন করা

আপনি যখন ফোন হাতে নেন, তখন নিজেকে প্রশ্ন করুন—“আমি কেন এটা খুলেছি?”

আপনি যদি বুঝতে পারেন যে এটি শুধুমাত্র অভ্যাসবশত করছেন, তাহলে নিজেকে থামানোর চেষ্টা করুন। ফোনের প্রতি আকর্ষণ অনেকটা ক্ষুধার মতো, তবে আপনি এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। নিজেকে বলুন, “হ্যাঁ, ফোন দেখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু আমি অন্য কিছু করেও সময় কাটাতে পারি।”

শেষ কথা

অতিরিক্ত স্ক্রলিং আমাদের মানসিক প্রশান্তি নষ্ট করতে পারে এবং মূল্যবান সময় অপচয় করতে পারে। তবে সামান্য সচেতনতার মাধ্যমেই এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সময় বাঁচাতে এবং আরও উৎপাদনশীল হতে এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Loading posts...