Recent post

শুক্রবার, ২৮ জুলাই, ২০১৭

অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য প্রসঙ্গে বিশ্লেষকদের প্রশ্ন কারা ক্ষমতাবান দুর্নীতিবাজ



গণমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিন ব্যাংক খাতসহ বিভিন্ন দফতর ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভয়াবহ দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। অনেক সময় অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তির পক্ষ থেকে আত্মপক্ষ সমর্থন করে কোনো ব্যাখ্যা কিংবা বক্তব্যও দেয়া হয় না।

এ অবস্থায় দুর্নীতিবাজদের ধরতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হটলাইন চালু খারাপ কিছু নয়, তবে মনে রাখতে হবে শুধু চুনোপুঁটিদের ধরলে হবে না। সমাজের বড় বড় রাঘববোয়ালদের শক্ত ভাবে ধরতে হবে।

বৃহস্পতিবার দুদকের হটলাইন উদ্বোধন প্রসঙ্গে কয়েকজন বিশ্লেষক এমন মন্তব্য করেন। একই সঙ্গে এ অনুষ্ঠানে দেয়া অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের আলোচিত বক্তব্যের বিশ্লেষণে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন।

কয়েকজন অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘যাদের হাতে ক্ষমতা তারাই দুর্নীতি করে’- শুধু এমন বক্তব্য দিয়ে দায়িত্ব শেষ করলে হবে না। ক্ষমতাবান দুর্নীতিবাজ কারা তা স্পষ্ট করে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থাও নিতে হবে।

এ বিষয়ে শুক্রবার যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে তারা আরও বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়। এসব টাকার বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে যায়। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। এছাড়া সরকারি বড় বড় প্রকল্পগুলোতে বড় দুর্নীতির শঙ্কা তো অর্থমন্ত্রী কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে পরিষ্কার করেন।

দুর্নীতির খবর জানাতে বৃহস্পতিবার একটি হটলাইন উদ্বোধন করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

এ সময় তিনি তার বক্তৃতায় বলেন, দুর্নীতি আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। যাদের ক্ষমতা আছে তারাই দুর্নীতি করে। পরোক্ষভাবে আমরা সবাই দুর্নীতিতে জড়িত। মুহিত বলেন, খুব তাড়াতাড়ি এ দুর্নীতি শুধরে ফেলা সম্ভব নয়।

এ ব্যাপারে মন্তব্য জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন- যারা ক্ষমতাবান, তারা দুর্নীতিবাজ এটা অত্যন্ত একটা সরল সমীকরণ। সবক্ষেত্রে এটি সত্য নয়। সমাজে অনেক ক্ষমতাবান লোক আছেন, এমনকি মন্ত্রী পর্যায়েও অনেক আছেন, যারা দুর্নীতি করেন না। তাই ঢালাওভাবে সবাইকে দুর্নীতিবাজ বলা ঠিক হয়নি। এতে করে বড় দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া দুর্নীতি বন্ধ হোক, এটা তিনি (অর্থমন্ত্রী) নিজেও চান না। না হলে অর্থমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও সোনালী ও বেসিক ব্যাংকের বড় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তিনি কোনো পদক্ষেপ নিলেন না কেন? তিনিও তো একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তি বা মন্ত্রী। তার মানে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার বা দুর্নীতিবাজদের প্রতি সহনশীল। এটাও কিন্তু এক ধরনের দুর্নীতি। এ সমীকরণে তিনি নিজেও একজন দুর্নীতিবাজ হয়ে যাচ্ছেন। তাই গণহারে সবাইকে দুর্নীতিবাজ আখ্যা দেয়ার বক্তব্য সমর্থন করি না। কারণ এ সমাজে বেশিরভাগ মানুষ সৎ। কিছু মানুষ অসৎ আছে। বাস্তবতা হল, দুর্নীতির কথা বললেও দুর্নীতি প্রতিহতের কোনো অঙ্গীকার নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এমএ তসলিম যুগান্তরকে বলেন, এ বক্তব্যের মাধ্যমে পুরো দেশকে দুর্নীতিবাজ প্রমাণ করলেন অর্থমন্ত্রী। অথচ তিনি এখনও বহুল আলোচিত সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতি ও বেসিক ব্যাংকে লুটপাটকারীদের পুরোপুরি বিচারের আওতায় আনতে পারেননি। তাদের বিরুদ্ধে জোরালা কোনো বক্তব্য বা অবস্থানও নেই তার। উল্টো সবাইকে গণহারে দুর্নীতিবাজ বলছেন। এতে সুনির্দিষ্ট এবং নানাভাবে প্রমাণিত শীর্ষ দুর্নীতিবাজরা পার পেয়ে যাবে।

তার মতে, দুর্নীতি দমনে দেশে নতুন আইনের প্রয়োজন নেই। কারণ এগুলো এক ধরনের ‘আইওয়াশ’। দেশে প্রচলিত আইনের বাস্তবায়ন হয় না। পুরনো সব আইন কার্যকর করা হোক। তাহলে দুর্নীতিসহ সব অপকর্ম বন্ধ হয়ে যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের কিছুটা সত্যতা রয়েছে। কারণ যাদের হাতে ক্ষমতা নেই, তারা দুর্নীতি করতে পারে না। তবে প্রশ্ন হল, ক্ষমতা কাদের হাতে। এটি স্পষ্ট হলে উত্তর পাওয়াটা নিশ্চয় কঠিন হবে না।

তিনি বলেন, আসলে রক্ষকরাই ভক্ষক। তাই সরকার যদি মেরুদণ্ড শক্ত করে না দাঁড়ায় তাহলে সবই কথার কথা বলে প্রতীয়মাণ হবে। বাস্তবে কিছুই হবে না। আর তা দুর্নীতি দমনের নামে এক ধরনের তামাশা বলে বিবেচিত হবে।

তিনি বলেন, বর্তমানে আর্থিক খাতে বেশি লুটপাট হচ্ছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্তরা এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত।

তিনি বলেন, সাধারণ একজন ব্যবসায়ী সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণই পান না। কারণ সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে ক্ষমতার জোর লাগে।

আবু আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করে না। আবার যারা এ ক্ষমতার জোরে ২ বছর আগে ঋণ পুনর্গঠন করেছেন তারা ঋণও পরিশোধ করছেন না।

তিনি আরও বলেন, পত্রিকাসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে বড় বড় দুর্নীতির খবর প্রতিদিন প্রকাশিত হয়। এগুলো আসল দুর্নীতিবাজ। এদের ধরলে ছোট দুর্নীতিবাজরা এমনিতেই সোজা হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন।

অপর একজন বিশ্লেষক বলেন, দুদকের বর্তমান চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের নেতৃত্বে দুর্নীতি দমনে বেশ কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এখন প্রয়োজন নিজের ইমেজ ধরে রাখতে চিহ্নিত বড় বড় দুর্নীতিবাজদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে আরও শক্ত পদক্ষেপ নেয়া।

এদিকে দুদক কমিশনার ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, দুর্নীতি সবই সমান। এখানে বড়-ছোট নেই। তবে দুর্নীতির কোনো ঘটনা অনুসন্ধান এবং তদন্তের জন্য কাগজপত্র ও এভিডেন্স লাগবে।

তিনি বলেন, দুদকের সিডিউলে অনেক কিছু নেই। ফলে সব বিষয়ে তদন্ত করা যায় না। এতে কিছু সমস্যা তো হয়।

তিনি বলেন, গণমাধ্যমকে আমরা অবশ্যই গুরুত্ব দেই। সে ক্ষেত্রে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যদি সুনির্দিষ্ট এবং তথ্যভিত্তিক হয় তবে অব্যশই সেটি আমরা গ্রহণ করে থাকি।

জানতে চাইলে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হাফিজ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, পত্রিকাতে প্রতিদিনই বড় দুর্নীতির খবর ছাপা হয়। এসব খবরের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ এবং সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকে। কিন্তু দুর্নীতিবাজদের ধরা হয় না।

তিনি মনে করেন, পত্রিকার খবর ছাড়াও প্রতিদিনই নামে-বেনামে শত শত চিঠি যায় দুদকে।
 প্রশ্ন হল, সেগুলোর কতটা তদন্ত হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

Popular Posts