প্রবাসীদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিঃ কারণ ও প্রতিকার



প্রবাসীদের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি: কারণ ও প্রতিকার

বিশ্বায়নের এই যুগে কর্মসংস্থান, উচ্চশিক্ষা বা উন্নত জীবনের সন্ধানে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজ দেশ ছেড়ে প্রবাসে বসবাস করছেন। নতুন পরিবেশ, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার চাপ প্রবাসীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে, হৃদরোগের মতো মৃত্যুঝুঁকিপূর্ণ রোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়া উদ্বেগজনক। এই প্রবন্ধে আমরা জানবো—কেন প্রবাসীদের হৃদরোগের ঝুঁকি বেশি হয় এবং এর থেকে বাঁচার উপায় কী।


প্রবাসীদের হৃদরোগের প্রধান কারণসমূহ

১. মানসিক চাপ ও একাকীত্ব
প্রবাস জীবন প্রায়ই মানসিক চাপের সঙ্গী। নতুন দেশে ভাষা, সংস্কৃতি ও পেশাগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে গিয়ে অনেকেই দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপে ভোগেন। এছাড়া, পরিবার ও বন্ধুদের থেকে দূরে থাকার কারণে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও একাকীত্ব দেখা দেয়। গবেষণায় প্রমাণিত, দীর্ঘদিনের স্ট্রেস কর্টিসল হরমোন বাড়িয়ে রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি করে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

২. অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
প্রবাসে অনেকেই স্থানীয় খাবারের সাথে মানিয়ে নিতে গিয়ে ফাস্ট ফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার বা রেডি-টু-ইট মিলের দিকে ঝুঁকেন। এসব খাবারে থাকে ট্রান্স ফ্যাট, অতিরিক্ত লবণ ও চিনি, যা রক্তে কোলেস্টেরল বাড়ায় এবং ধমনী ব্লক হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশীয় প্রবাসীদের মধ্যে ভাত-রুটির পাশাপাশি তেল-মসলাযুক্ত খাবারের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

৩. শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা
প্রবাসে কর্মব্যস্ততা, প্রতিকূল আবহাওয়া বা নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেকের শারীরিক পরিশ্রম কমে যায়। অফিসে দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ, গাড়ি ব্যবহারের প্রবণতা এবং হাঁটাহাঁটির অভাব মেদবৃদ্ধি, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের মতো সমস্যা তৈরি করে।

৪. স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অবহেলা
অনেক প্রবাসীই ব্যস্ততার অজুহাত বা চিকিৎসা ব্যয়ের ভয়ে নিয়মিত ব্লাড প্রেশার, কোলেস্টেরল বা ব্লাড সুগার চেক করান না। ফলে উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসের মতো নীরব ঘাতকগুলো ধরা পড়ে না, যা পরবর্তীতে হৃদরোগের দিকে নিয়ে যায়।

৫. ধূমপান ও মদ্যপান
নতুন দেশে মানসিক চাপ কমানোর জন্য অনেকে ধূমপান বা অ্যালকোহলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ধূমপান সরাসরি হৃদপিণ্ডের রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং অ্যালকোহল রক্তচাপ বাড়ায়।


হৃদরোগ প্রতিরোধের উপায়

১. স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট

  • মেডিটেশন ও যোগব্যায়াম: দিনে ১৫-২০ মিনিট ধ্যান বা প্রাণায়াম কর্টিসল হরমোন কমাতে সাহায্য করে।
  • সামাজিক সংযোগ: স্থানীয় কমিউনিটি বা প্রবাসী গ্রুপের সাথে যুক্ত থাকুন। পরিবারের সাথে ভিডিও কলে নিয়মিত কথা বলুন।
  • কাউন্সেলিং: মানসিক চাপ বেশি মনে হলে পেশাদার কাউন্সেলর বা থেরাপিস্টের সাহায্য নিন।

২. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস

  • হোমমেড খাবার: সময় বের করে রান্না করুন। তাজা শাকসবজি, মাছ, ডাল ও গোটা শস্য রাখুন ডায়েটে।
  • লবণ ও চিনি কম intake: প্রক্রিয়াজাত খাবার, কোমল পানীয় ও প্যাকেটজুস এড়িয়ে চলুন।
  • মসলার ব্যবহার: হলুদ, রসুন ও আদা রক্তনালীর স্বাস্থ্য উন্নত করে।

৩. নিয়মিত ব্যায়াম

  • সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম (যেমন: দ্রুত হাঁটা, সাইকেল চালানো) করুন।
  • অফিসে কাজের ফাঁকে প্রতি ১ ঘণ্টায় ৫ মিনিট হাঁটুন বা স্ট্রেচিং করুন।

৪. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা

  • বছরে অন্তত একবার লিপিড প্রোফাইল, ব্লাড প্রেশার, ব্লাড সুগার এবং ইসিজি টেস্ট করান।
  • যদি ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তা নিয়ন্ত্রণে রাখুন ওষুধ ও ডায়েটের মাধ্যমে।

৫. ধূমপান ও অ্যালকোহল ত্যাগ

  • সিগারেট ছাড়ার জন্য নিকোটিন প্যাচ বা কাউন্সেলিং নিন।
  • অ্যালকোহল সপ্তাহে ১-২ দিনের বেশি না খাওয়াই ভালো।

হৃদরোগের লক্ষণ চিনুন

  • বুকের মাঝখানে তীব্র ব্যথা বা চাপ লাগা (ব্যথা হাত, ঘাড় বা চোয়ালে ছড়াতে পারে)।
  • শ্বাসকষ্ট, বমি বমি ভাব বা ঘাম হওয়া।
  • মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।


সচেতনতাই মূল হাতিয়ার

প্রবাসে হার্ট অ্যাটাকের বিরুদ্ধে লড়াই করতে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের কোনো বিকল্প নেই। 

পাশাপাশি, প্রবাসী কমিউনিটিগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য—সেমিনার আয়োজন করা, হেলথ ক্যাম্পের ব্যবস্থা করা বা হেল্পলাইন চালু করা। 

মনে রাখবেন, সুস্থ থাকার জন্য শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়াও জরুরি।    

  

"হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধযোগ্য—শুধু প্রয়োজন সঠিক জ্ঞান ও প্রয়োগের।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ