গত বৃহস্পতিবার সাধারণ পরিষদে ট্রাম্পের ঘোষণা প্রত্যাখ্যানের পক্ষে ১২৮টি দেশ ভোট দেয়। বিপক্ষে ভোট দেয় মাত্র ৯টি দেশ।
প্রকারন্তরে যারা ভোট দেয়নি, তাদের মনোভাবও ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই গেছে।
সাধারণ পরিষদের আগে গত সোমবার নিরাপত্তা পরিষদে ট্রাম্পের ঘোষণা বাতিলের একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হলে তাতে ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
পরিষদের বাকি ১৪ সদস্যই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়।
মূলত নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব বা সিদ্ধান্ত কার্যকরযোগ্য বলে বিবেচিত হয়।
পরিষদের যে কোনো স্থায়ী সদস্য দেশ ‘ভেটো’ দিলে প্রস্তাব বাতিল বলে গণ্য হয়।
পক্ষান্তরে সাধারণ পরিষদে পাস হওয়া যে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়টি ঐচ্ছিক।
নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাবটি পাস করানো সম্ভব না হওয়ায় তা সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করে তুরস্ক ও ইয়েমেন।
সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত প্রস্তাবে বলা হয়, জেরুজালেম নিয়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত অকার্যকর এবং তা অবশ্যই বাতিল করতে হবে। সাধারণ পরিষদ বৈঠক শুরুর আগে ট্রাম্প হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, প্রস্তাবের পক্ষে যেসব দেশ ভোট দেবে তাদের আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়া হবে।
তিনি দেশগুলোর উদ্দেশে বলেন, তারা লাখ, লাখ কোটি কোটি ডলার সাহায্য নিচ্ছে আর আমাদেরই বিরুদ্ধে ভোট দিতে যাচ্ছে। কারা এ ভোট দেয় তা আমরা দেখব।
এমনকি সাধারণ পরিষদে ভোটাভুটির আগে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি নিকি হ্যালি বলেন, এখানে ‘না’ ভোট দেয়া হলেও তার কোনো মানে নেই।
তবে দিনটি যুক্তরাষ্ট্র মনে রাখবে, জাতিসংঘে যারা যুক্তরাষ্ট্রকে হেনস্তা করে, তাদের মনে রাখবে। যুক্তরাষ্ট্রের এত হুমকি-ধমকি সত্তে¡ও ট্রাম্পের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পক্ষে নিরঙ্কুশ ভোট পড়ায় বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সাধারণ পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সুপার ডিফিট’ হয়েছে।
এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে দেশটির একঘরে হওয়ার বার্তা দেয়া হয়েছে।
গত ৬ ডিসেম্বর ইসরাইল ও ফিলিস্তিন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভারসাম্যমূলক নীতির অবসান ঘটিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণা দেন।
গত ৬ ডিসেম্বর ইসরাইল ও ফিলিস্তিন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভারসাম্যমূলক নীতির অবসান ঘটিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণা দেন।
এতে সারা বিশ্বে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে।
বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব তীব্র প্রতিক্রিয়া ও বিক্ষুদ্ধতা প্রদর্শন করে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র রাষ্ট্রগুলোও এর বিরোধিতা করে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী দল হামাস নতুন করে ইন্তিফাদা ঘোষণা দেয়।
সেখানে প্রতিদিন বিক্ষোভ চলছে। ইসরাইল তা কঠোর হাতে দমন করে যাচ্ছে এবং বিমান হামলাও করছে। এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে ১০ জন।
অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে। বাংলাদেশেও ট্রাম্পের ঘোষণার বিরোধিতা করে বিক্ষোভ হয়েছে।
ওআইসি বৈঠক করে এর তীব্র বিরোধিতা করেছে। ওআইসির পক্ষ থেকে জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী ঘোষণা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ স্বীকৃতির ফলে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘকাল ধরে যে শান্তি প্রক্রিয়া চলমান ছিল, তা এক প্রকার ভেস্তে দেয়া হয়েছে। ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে ধীর গতিতে হলেও যে শান্তি প্রক্রিয়া এবং বিভিন্ন চুক্তি সম্পাদন হয়েছে, তা এক নিমিষে উড়িয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প।
অথচ এই শান্তি প্রক্রিয়ার অন্যতম মধ্যস্ততাকারী ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
ট্রাম্প কেন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব অবস্থান থেকে একেবারে ৩৬০ ডিগ্রী ঘুরে গেলেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্ট আইএস দুর্বল হয়ে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে তার অবস্থান পুনরায় জানান দেয়ার জন্য এ কাজ করে থাকতে পারেন।
এর মাধ্যমে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য ধরে রাখতে চাইছেন। এ ধরনের সিদ্ধান্ত একেবারেই হটকারি এবং অবিবেচনাপ্রসূত। এতে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়া যেমন ভেঙে পড়তে বসেছে, তেমনি সারাবিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবও হুমকির মুখে পড়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়া এবং যুদ্ধের অবসানের পর যুক্তরাষ্ট্রের যে একচ্ছত্র আধিপত্য বিশ্বজুড়ে বিদ্যমান ছিল, ট্রাম্পের এক ঘোষণায় তা দুর্বল হয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররাষ্ট্র থেকে শুরু করে বেশিরভাগ দেশই এখন তার বিরোধিতা করা শুরু করেছে।
এতে যে দেশটি অনেকটা একঘরে হয়ে পড়ল, তাতে সন্দেহ নেই।
ট্রাম্পের দাবী অনুযায়ী, যেসব দেশকে যুক্তরাষ্ট্র কোটি কোটি ডলার আর্থিক সহায়তা দিত, সেসব দেশও এখন আর দেশটির ডলারের তোয়াক্কা করছে না।
তুরষ্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ইতোমধ্যে দেশগুলোকে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, গণতন্ত্রের সূতিকাগার যুক্তরাষ্ট্র এখন ডলার দিয়ে মানুষের ইচ্ছা কিনতে চাচ্ছে।
গণতন্ত্রের লড়াইয়ে নিজেদের ইচ্ছা বিক্রি করবেন না।
জাতিসংঘ অধিবেশনে তুরষ্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তুরষ্ক কখনো জেরুজালেমকে ছেড়ে যাবে না, ফিলিস্তিনিরা নিঃসঙ্গ থাকবে না।
অন্যদিকে ইসরাইল অত্যন্ত উদ্ধত মনোভাব প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত বলেন, সাধারণ পরিষদের কোনো প্রস্তাবই আমাদের জেরুজালেম থেকে বিতাড়িত করতে পারবে না। এর আগে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, জাতিসংঘ স্বীকার করুক বা না করুক, জেরুজালেম ইসরাইলের রাজধানী।
বলা বাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় ইসরায়েল এই হম্বিতম্বি করছে।
আই ইসরাইলকে সমর্থন দিতে গিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে পুরোবিশ্ব থেকে যেমন এক প্রকার বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন, তেমনি নিজ দেশের জনগণের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছেন।
জেরুজালেম নিয়ে বিশ্ব সেন্টিমেন্ট ও জনমতকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ট্রাম্পের এ ঘোষণা থেকে সরে আসার জন্য আমরা আহ্বান জানাই।
জেরুজালেম নিয়ে বিশ্ব সেন্টিমেন্ট ও জনমতকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ট্রাম্পের এ ঘোষণা থেকে সরে আসার জন্য আমরা আহ্বান জানাই।
তাকে বুঝতে হবে, তার এ ঘোষণা মুসলিম বিশ্ব তো বটেই বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই মেনে নেয়নি। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দেশগুলোর সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়বে।
ইসরাইলের জন্য পুরো বিশ্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিচ্ছিন্ন হওয়া কতটা যৌক্তিক তা ট্রাম্পকে বুঝতে হবে। তাকে এটাও বুঝতে হবে তার পূর্বসূরীরা কেন ও কী কারণে এ ধরনের সিদ্ধান্ত না নিয়ে শান্তি প্রক্রিয়া এবং ভারসাম্যমূলক নীতি ও অবস্থান অনুসরণ করেছিলেন।
আমরা মনে করি, সবদিক বিবেচনা করে ট্রাম্পের এ ঘোষণা থেকে সরে আসা উচিত।
অন্যদিকে মুসলমান দেশগুলোর উচিত হবে, এর বিরুদ্ধে একজোট হয়ে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখা এবং ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা।
ওআইসি জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী ঘোষণার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা বাস্তবায়নে সদস্য দেশগুলোকে দৃঢ় ভূমিকা রাখতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন