শিশুর সঠিক বৃদ্ধি ও বিকাশ নিয়ে প্রতিটি বাবা মায়ের দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না। নতুন বাবা মা বিশেষ করে যাদের প্রথম সন্তান তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকার ফলে তাদের উদ্বিগ্নতা একটু বেশিই থাকে।
বেশির ভাগ বাবা-মা ই শিশুর স্বাস্থ্যগত অবস্থা নিয়ে অনেক বেশি চিন্তায় থাকেন। প্রায় সবারই অভিযোগ থাকে যে শিশু খেতে চায়না, একই বয়সের অন্য শিশু তাদের চেয়ে বড়, শিশুর স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে, ওজন ঠিক আছে কিনা, শিশুর যত্নে কোন ত্রুটি হচ্ছে কিনা, এসব নানা ধরনের চিন্তায় হয়তো দেখা যায় তারা তাদের সুস্থ শিশুদের নিয়ে ডাক্তারের কাছে দৌড়াচ্ছেন।
তবে এসব চিন্তা থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত থাকা সম্ভব যদি শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি ও কর্ম দক্ষতা কিসের উপর নির্ভর করে সেই বিষয় গুলো সম্পর্কে তারা কিছুটা ধারনা রাখেন।
শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি, বিকাশ ও কর্মদক্ষতা নিম্নোক্ত কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে:
জীনগত কারন:
লম্বা বাবা মায়ের সন্তান সাধারণত দ্রুত লম্বা হয় আর খাটো বাবা মায়ের সন্তানের বৃদ্ধি ধীর হয়। এটা জীনগত কারণেই হয়ে থাকে।
পুষ্টিগত কারণ:
পুষ্টির অভাবে যেমন শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, তেমনি অতিরিক্ত পুষ্টি শিশুকে মেদবহুল করে। শরীরের কম ওজনের মত বেশি ওজনকেও এক ধরনের অপুষ্টি বলে।
আর্থ-সামাজিক কারণ:
সাধারনভাবে দারিদ্রতা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি ও কর্মদক্ষতা দুটোকেই ব্যাহত করে। যে পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো সেই পরিবারের শিশুদের শারিরিক বৃদ্ধি, বিকাশ ও কর্মদক্ষতা স্বাভাবিকভাবেই ভালো থাকবে।
পারিপার্শ্বিকতা:
উন্নত সামাজিক, মানসিক ও পারিপার্শ্বিকতা শিশুদের কর্মদক্ষতা ও দৈহিক বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে।
অসুস্থতা:
দীর্ঘদিন কোন শিশু অসুস্থতায় ভুগলে সেই শিশুর দৈহিক ও মানসিক বিকাশ দুটোই বিলম্বিত হয়। ওজন কমে যায়, খাবারের রুচিও কমে আসে।
মানসিক আঘাত:
পরিবার, সমাজ ও পরিবেশ থেকে যে কোনভাবে মানসিক আঘাত পেলে বা চাপে থাকলে সেই শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধির ব্যাঘাত ঘটে।
গর্ভাবস্থায়:
মায়ের পেটে শিশুর স্বাভাবিক ও যথাযথ বৃদ্ধি না হলে, জন্মের পর সেই শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি খুব ধীর গতিতে হয় এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব নিয়ে সেই শিশু জন্ম গ্রহন করে।
শিশুর স্বাভাবিক দৈহিক বৃদ্ধি পরিমাপের উপায় সমূহ:
উচ্চতা:
শিশু তার নির্দিষ্ট বয়স অনুযায়ী বাড়ছে কিনা সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। সাধারণত জন্মের সময় শিশুর উচ্চতা থাকে - ৫০ সেমি, ১ বছরে - ৭৫ সেমি, ২ বছরে - ৮৩ সেমি, ৩ বছর বা এর পরে প্রতি বছর ৫ সেমি করে শিশুরা বাড়ে।
ওজন:
জন্মের সময় একটি শিশুর স্বাভাবিক ওজন থাকে ২.৫-৪ কেজি পর্যন্ত। তারপর ৬ মাসে এই ওজন ২ গুন হবে, ১ বছরে ৩ গুন এবং ২ বছরে হবে ৪ গুন। এটাই হচ্ছে স্বাভাবিক নিয়ম। যদি এর ব্যতিক্রম হয় তবেই সেদিকে নজর দিতে হবে।
বাহুর মধ্যঅংশের পরিধি:
পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুদের পুষ্টির অভাব আছে কিনা, তা পরিমাপ করার আরো একটি পদ্ধতি হলো শিশুর বাহুর মধ্যঅংশের পরিধি পরিমাপ করা।
- যদি বাহুর মধ্যঅংশের পরিধি ১৩.৫ সেমি এর উপরে হয় তবে বুঝতে হবে শিশুটির দেহে পুষ্টির অভাব নেই।
- বাহুর মধ্যঅংশের পরিধি ১২.৫ সেমি হইতে ১৩.৫ সেমি এর মাঝে হলে বুঝতে হবে শিশুটি কিছুটা অপুষ্টিতে ভুগছে।
- আর বাহুর মধ্যঅংশের পরিধি ১২.৫ সেমি এর নিচে হলে বুঝতে হবে শিশুটি মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে।
শিশু সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠছে কিনা তা বোঝার জন্য শুধুমাত্র দৈহিক বৃদ্ধির দিকেই দৃষ্টি রাখলে চলবে না তার কর্মদক্ষতা ও মানসিক বিকাশের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
শিশুর কর্মদক্ষতা ও মানসিক বৃদ্ধির মাপকাঠিগুলো:
স্নায়ুবিক বৃদ্ধি:৩-৪ মাস বয়সে শিশু ঘাড় সোজা করতে, ৬-৮ মাস বয়সে বসতে আর ১১-১৩ মাস বয়সে হাঁটতে শিখে।
দৃষ্টিশক্তির বিকাশ:
৩-৪ মাস বয়স হলে শিশু উজ্জ্বল কিছু দেখলে তার দিকে খেয়াল করে, ৬ মাস বয়সে ছোট বস্তুও দেখতে পারে। ৬ মাস বয়সে শিশুর হাতের তালুতে কোন কিছু ধরলে তা চেপে ধরে আর ১০ মাস বয়সে শিশু ভালভাবে কোন কিছু ধরতে পারে।
স্মৃতিশক্তির বিকাশ:
শিশুর বয়স যখন ৪-৫ মাস হয় তখন তার কাছে কোন শব্দ করলে মাথা ঘুরায় আর ৮-৯ মাস বয়সে কোথায় শব্দ হচ্ছে সেটা বুঝতে পারে।
কথা বলার ক্ষমতা:
শিশুর বয়স ৫-৬ মাস হলে দা দা, মা মা ইত্যাদি কিছু অর্থহীন শব্দ করে আর বয়স এক বৎসর পূর্ণ হলে দুই তিনটি অর্থপূর্ণ শব্দ বলতে শেখে।
উপরোক্ত বিষয়গুলো যদি শিশুর মাঝে দেখা যায় তাহলে বুঝতে হবে যে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ও বিকাশ সঠিক ভাবেই হচ্ছে।
তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে এই মাপকাঠিগুলো কিন্তু স্থির নয়। তাই শিশুকে নিয়ে দু:চিন্তা না করে তাদেরকে প্রয়োজনীয় সময় দিন এবং তাদের প্রতি খেয়াল রাখুন।
শওকত আরা সাঈদা
জনস্বাস্থ্য পুষ্টিবিদ
এক্স ডায়েটিশিয়ান, পারসোনা হেল্থ, খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান (স্নাতকোত্তর) (এমপিএইচ), নিউট্রিশন এবং ডায়েট থেরাপিতে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন